Top News

ডিওয়াই পাতিলের এক ঐতিহাসিক সন্ধ্যা: ভারতের প্রথম নারী বিশ্বকাপ জয়


ফাইনালের সামগ্রিক চিত্র: এক অনবদ্য সন্ধ্যায় ইতিহাসের নতুন অধ্যায়

২০২৫ সালের ২ নভেম্বর, রবিবার। নবি মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হল গোটা বিশ্ব ক্রিকেট। প্রায় ৬০,০০০ দর্শকে ঠাসা গ্যালারিতে ভারতীয় মহিলাদের বিশ্বকাপ জয় যেন এক জাতীয় উৎসবে রূপ নিল। বৃষ্টির কারণে ম্যাচের সময় পিছিয়ে শুরু হয় সন্ধ্যা ৫টা থেকে, কিন্তু উত্তেজনা একটুও কমেনি।
দক্ষিণ আফ্রিকা টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের ভার পরে গিয়েছিল পুরো দলের ওপর। ভারত এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলে প্রমাণ করে দিল, কেন তারা সেরা।

ভারত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে করে ২৯৮ রান, জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা গুটিয়ে যায় ২৪৬ রানে। ৫২ রানের জয়ে ভারতীয় মেয়েরা ইতিহাসে নাম লেখাল, এটাই ভারতের প্রথম মহিলা বিশ্বকাপ জয়, এবং তাও ঘরের মাঠে।

ম্যাচ শেষে মাঠজুড়ে দেখা গেল অশ্রুভেজা উল্লাস—জেমিমাহ রডরিগস, স্মৃতি মান্ধানা, হারমানপ্রীত কৌর, রেনুকা সিং—প্রত্যেকে নিজেদের সক্ষমতার বেশি খেলেছেন। ভারতের নারী ক্রিকেট দল এখন বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তালিকায় চতুর্থ দেশ। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের পর।


ফাইনালের আগে বৃষ্টির নাটক: অপেক্ষার প্রহর ও দর্শকদের ধৈর্য

ফাইনাল ম্যাচের নির্ধারিত সময় ছিল বিকেল ৩টে। কিন্তু দুপুরের দিকে নবি মুম্বাইয়ে নেমে আসে প্রবল বৃষ্টি, যার কারণে টস ও খেলা প্রায় দুই ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয়। মাঠের আউটফিল্ড শুকনো করতে কর্মীদের লড়াই চলেছিল ঘন্টার পর ঘন্টা। অবশেষে স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় শুরু হয় মহারণ।

স্টেডিয়ামে অপেক্ষার প্রহর যেন রূপ নেয় এক উৎসবে। দর্শকরা মোবাইলের আলো জ্বেলে “ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া” স্লোগান তুলেছিলেন। আকাশে রামধনু দেখা দিলে তা যেন ভারতের ভবিষ্যৎ সাফল্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়াম এতদিন পুরুষ ক্রিকেটের ঐতিহাসিক ম্যাচগুলোর সাক্ষী থেকেছে, কিন্তু এবার প্রথমবার মহিলা বিশ্বকাপ ফাইনাল আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছিল। নিরাপত্তা, সম্প্রচার ও দর্শক ব্যবস্থাপনা, সব কিছু মিলিয়ে আয়োজক কমিটি অসাধারণভাবে দায়িত্ব পালন করে।


টস ও ভারতের ইনিংস: শেফালি ও দীপ্তির ব্যাটে রঙিন অধ্যায়

দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক লরা ওলভার্ড টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের দুই ওপেনার—স্মৃতি মান্ধানা ও শেফালি বর্মা—শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিলেন। প্রথম উইকেট পড়ে ৮৪ রানে, কিন্তু তারপর মাঠে আসেন জেমিমাহ রডরিগেস, যিনি সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ১২৭ রানের ইনিংস খেলে ভারতকে ফাইনালে তুলেছিলেন।

এই ম্যাচে শেফালির ব্যাট যেন স্বপ্নের মতো চলেছে। তিনি করেন ৮৭ রান (৭৮ বলে, ৭ চার, ২ ছক্কা)। তাঁর সঙ্গে দীপ্তি করেন ৫৮ রান (৫৮ বলে, ৩ চার, ১ ছক্কা), যার ফলে ভারতীয় স্কোরবোর্ড প্রায় ৩০০ স্পর্শ করে।

ব্যাটসম্যান

রান

বল

৪s

৬s

স্ট্রাইক রেট

শেফালি বর্মা

৯২

৭৮

১১১.৫৪

স্মৃতি মান্ধানা

৪৫

৫৮

৭৭.৫৯

দীপ্তি শর্মা

৫৮

৫৮

১০০

রিচা ঘোষ

৩৪

২৪

১৪১.৬৭

 

দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস: ভারতীয় বোলারদের নিখুঁত প্রতিশোধ

২৯৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা শুরু থেকেই চাপে পড়ে যায়। ভারতের তরুণ পেসার অমনজোত কৌর প্রথম দশ ওভারেই ওপেনার ব্রিটকে ফেরান। এরপর দীপ্তি শর্মা ও শ্রী চরণীর স্পিনে মধ্যক্রম ভেঙে পড়ে।

লরা ওলভার্ড কিছুটা লড়াইয়ের চেষ্টা করেন ১০১ রান করে, কিন্তু রেনুকা, ক্রান্তি ও রাধা মিলে একের পর এক ধাক্কা দেন। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার দল ২৪৬ রানে অলআউট হয় ৪৫.৩ ওভারে।

বোলার

ওভার

রান

উইকেট

ইকোনমি

রেনুকা সিং

২৮

৩.৫০

দীপ্তি শর্মা

৯.৩

৩৯

৪.১০

শ্রী চরণী

৪৮

৫.৩০

অমনজোত কৌর

৩৪

৮.৫০

রাধা যাদব

৪৫

৯.০০

শেফালী বর্মা

৩৬

৫.১০

ক্রান্তি গৌড়

১৬

৫.৩০


পুরস্কার ও সন্মাননা: ভারত চ্যাম্পিয়ন

ম্যাচ শেষে মাঠে উল্লাসের ঝড় বইয়ে দেয় ভারতীয় দল। শেফালি বর্মা নির্বাচিত হন প্লেয়ার অফ দ্য ফাইনাল, আর টুর্নামেন্ট সেরা হন দীপ্তি শর্মা, যিনি পুরো টুর্নামেন্টে ২২টি উইকেট নিয়েছেন।

পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে আইসিসি-র সভাপতি শ্রী জয় শাহ ট্রফি তুলে দেন অধিনায়ক হারমানপ্রীত কৌরের হাতে। তাঁর চোখের জল যেন কোটি ভারতীয়র আবেগের প্রতিফলন। বিসিসিআই ঘোষণা করেছে, প্রতিটি খেলোয়াড় পাবেন ১ কোটি টাকা করে পুরস্কার, কোচিং স্টাফদেরও বিশেষ বোনাস দেওয়া হবে।

বিভাগ

বিজয়ী

পরিসংখ্যান

টুর্নামেন্ট সেরা

লরা ওলভার্ড

৫৭১ রান

সর্বোচ্চ উইকেট

দীপ্তি শর্মা

২২ উইকেট

সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর

লরা ওলভার্ড

১৬৯ রান

সেরা বোলিং পরিসংখ্যান

অ্যালানা কিং

৭-১৮

সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর

ভারত

৩৪১-৫

 

ইতিহাস ও রেকর্ড: এক নতুন যুগের সূচনা

ভারতের এই জয় শুধু ট্রফি নয়, এটা এক বিপ্লব। ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে শুরু হওয়া মহিলা বিশ্বকাপে ভারত এতদিন ফাইনাল খেলেছিল তিনবার (২০০৫, ২০১৭, ২০২৫), কিন্তু এবার প্রথমবার ট্রফি জয়। এবারের টুর্নামেন্টে ভারত সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়, এবং ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গৌরবময় সমাপ্তি পেয়েছে।

টুর্নামেন্ট রেকর্ড (ভারত)

ফলাফল

ম্যাচ খেলা

জয়

হার

ফলাফলহীন

সর্বোচ্চ দলীয় রান

৩৪১ বনাম অস্ট্রেলিয়া, ৩৪০ বনাম নিউজিল্যান্ড

সর্বনিম্ন দলীয় রান

২৪৭ বনাম পাকিস্তান

সেরা ব্যাটসম্যান (ম্যাচভিত্তিক)

জেমিমা রডরিগেস (১২৭ রান বনাম অস্ট্রেলিয়া)

সেরা বোলার (ম্যাচভিত্তিক)

দীপ্তি শর্মা (৫/৩৯ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা)

 

আবেগ, প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন

ফাইনাল জয়ের পর গোটা দেশে উৎসব শুরু হয়। মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরু—প্রতিটি শহর জ্বলে ওঠে আলোয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বলিউড তারকা, সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিনন্দন জানান ভারতীয় মেয়েদের।

হারমানপ্রীত কৌর বলেন, “আমরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, পুরো দেশের মেয়েদের জন্য লড়েছি। এই ট্রফি প্রত্যেক ভারতীয় নারীর জন্য।”
জেমিমাহ রডরিগস আবেগভরে বলেন, “এটা আমার জীবনের সেরা দিন। আমি ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখেছিলাম ভারতের জন্য বিশ্বকাপ জেতার—আজ সেটা সত্যি হলো।”

এই জয়ে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল। মহিলা প্রিমিয়ার লিগ (ডব্লিউ. পি. এল)-এর জনপ্রিয়তা, নতুন একাডেমি, উন্নত অবকাঠামো—সব মিলিয়ে ভারত এখন এক নতুন অধ্যায়ের পথে।


নতুন সূর্যের আলোয় ভারতীয় নারী ক্রিকেট

২০২৫ সালের এই জয় শুধু একটা ম্যাচ নয়, এক নতুন যুগের সূচনা। এই দল প্রমাণ করেছে যে স্বপ্ন, পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস থাকলে ইতিহাস রচনা করা যায়।

ভারতের মেয়েরা আজ শুধু বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নয়, তারা হয়ে উঠেছে কোটি কোটি তরুণীর অনুপ্রেরণা। যেভাবে ১৯৮৩ সালে কপিল দেবদের জয় ভারতের পুরুষ ক্রিকেটে বিপ্লব এনেছিল, ২০২৫ সালে হারমানপ্রীতদের জয় তেমনি নারী ক্রিকেটে এনে দিল এক নতুন ভোর।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন