এলেন, জয় করলেন, চলে গেলেন। সুচিত্রা সেনের জন্য এই কথা বোধ হয় যথার্থ। তিনিও খুব বেশি বছর বিনোদন জগতে থাকেননি। কিন্তু যতটুকু সময় তিনি থেকেছেন তার মধ্যে তিনি যে খ্যাতির পাহাড় তৈরি করেছেন তা এককথায় অলঙ্ঘনীয়। কেবল টলিউড না, বলিউডেও সমান দক্ষতায় কাজ করেছেন তিনি। সমাদৃত হয়েছেন সর্বত্রই। তিনি মহানায়িকা। তবে কেবল অভিনয় নয়, গানের জগতেও পা রেখেছিলেন মহানায়িকা।
আজ তাঁর জন্মবার্ষিকী। অধুনা বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার ভাঙাবাড়ির দাশগুপ্ত পরিবারে বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত এবং মা ইন্দিরা দাশগুপ্তর কোলে আসেন রমা। পা রাখেন বিনোদন জগতে। তিনি নিজের নাম বদলে পরবর্তীতে হন সুচিত্রা। সিনেমায় পা রাখার সময়েই নাম বদলান নিজের।
তাঁর অভিনয় দিয়ে সকলের মনজয় করে তিনি মহানায়িকা হয়ে ওঠেন ঠিকই। তবে তিনি গানের জগতেও নিজের ছাপ রেখে গিয়েছেন। সেই সময় সুচিত্রা সেনের গান রেকর্ডিং করেছিল বিখ্যাত এক কোম্পানি। তখনও তিনি রমা। সেই সময় তাঁর একটি মাত্র গান রেকর্ড করা হয়।
জানলে অবাক হবেন, রমা সেনকে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বামী দিবানাথ সেন। কিন্তু রমার গলা পছন্দ হয়নি রেকর্ডিং স্টেশনের কর্তাব্যক্তিদের। কারণ তাঁর উচ্চারণে ছিল পূর্ববঙ্গীয় টান। তবে, একটি গান এসেছিল মহানায়িকার কণ্ঠে।
প্রসঙ্গত, সুচিত্রার বৈবাহিক জীবন নিয়ে চর্চারঅন্ত নেই। শোনা যায়, স্বামী দিবানাথই নাকি তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলন ফিল্ম লাইনে। ১৯৫২ সালে শেষ কোথায় ছবি তাঁর প্রথম কাজ। যদিও তা মুক্তি পায়নি। তবে বিবাহিত জীবনে নাকি কোনও দিনই সুখী হতে পারেননি সেভাবে।
শোনা যায়, স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক সুখের ছিল না সুচিত্রার। বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই, স্বামীর থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন৷ তবে মিসেস সেনের মর্যাদা থেকে একচুলও সরেননি কখনও। এতটাই দৃঢ় চরিত্রের ছিলেন যে, নিজের চারপাশে রেখেছিলেন এক অদৃশ্য বলয়। যা ভেদ করার সাহস বা ক্ষমতা সেই সময়ের কম মানুষেরই ছিল।
১৯৯৬ সালে বলিউডের আইকনিক অভিনেতা ধর্মেন্দ্র ও টলিউডের হার্টথ্রব সুচিত্রা সেন একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। আর সেখানেই ঘটেছিল এই ‘অপ্রীতিকর’ ঘটনা। যার উল্লেখ ধর্মেন্দ্র নিজেই করেছিলেন পরবর্তীতে।
অসিত সেনের ‘মমতা’ ছবিতে জুটি বেঁধেছিলেন ধর্মেন্দ্র ও সুচিত্রা। অসিত সেনেরই পরিচালিত ‘উত্তর ফাল্গুনী’র (১৯৬৩) হিন্দি অ্যাডপশন ছিল ‘মমতা’। ততদিনে বাংলার ম্যাটিনি কুইন সুচিত্রা। তাঁকে দেখার জন্য হলের বাইরে পড়ে লম্বা লাইন। সৌন্দর্যে ঝড় তোলেন আট থেকে আশির মনে।
‘মমতা’য় দেবযানীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা, যে নিজের বিপন্ন বৈবাহিক জীবন থেকে বেরিয়ে আসে, এবং পরবর্তীতে ডান্সার পান্না বাঈ হিসেবে খ্যাতিলাভ করে। আর পরবর্তীতে পান্না বাঈ-ই আবার সব কিছু ত্যাগ করে, নিজের একমত্র মেয়ে সুপর্ণার জন্য। এই সিনেমায় অশোক কুমার ছিলেন দেবযানীর প্রেমিক। আর অপর্ণার প্রেমিক ইন্দ্রনীলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ধর্মেন্দ্র।
শোনা যায়, বিনা অনুমতিতে কারও সাহস ছিল না সুচিত্রা সেনকে স্পর্শ করার। সিনেমার প্রয়োজনে অবশ্য অনুমতি পেতেন নায়করা। তবে ধর্মেন্দ্র ‘মমতার’ শ্যুট চলাকালীন একসময় আচমাকই চুমু খান সুচিত্রার পিঠে। আর সেটি ছিল না স্ক্রিপ্টে। তবে দৃশ্যটি নাকি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, পরে সিনেমার ফাইনাল কাটে জায়গা পায়।
কিন্তু আচমকা ধর্মেন্দ্রর এরকম কাজে অপমানিত বোধ করেছিলেন সুচিত্রা। মারাত্মক রেগেও গিয়েছিলেন। এমনকী, বাংলার এই খ্যাতনামা নায়িকার কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন ধর্মেন্দ্র।
পরবর্তীতে সুচিত্রার সঙ্গে আরও কাজের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন ধর্মেন্দ্র। কিন্তু সুচিত্রার মন ছিল বাংলা সিনেমাতেই। এরপর শুধু ১৯৭৫ সালে সঞ্জীব কুমারের বিপরীতে গুলজারের 'আন্ধি' ছবিতে কাজ করেন সুচিত্রা সেন।
সুচিত্রা সেনের স্বেচ্ছা নির্বাসন ও মৃত্যু:
তবে বাংলার ম্য়াটিনি কুইন একসময় নিজেকে করেন গৃহবন্দি। শোনা যায়, ১৯৭৮ সালে 'প্রণয় পাশা' ছবি ফ্লপ করার পরে সুচিত্রা ছুটে গেছিলেন বেলুড় মঠে ভরত মহারাজের কাছে। ভরত মহারাজ বলে দেন ‘মা, লোভ কোরো না’। সুচিত্রাও এরপর সেই পথেই নিজেকে চালিত করেন।
এই ঘটনার দু'বছর পরে ১৯৮০ সালে সাংবাদিকদের ক্যামেরার চোখ এড়িয়ে মধ্যরাতে মহানায়ক উত্তম কুমারের বাড়িতে একবারই গিয়েছিলেন সুচিত্রা। উত্তমকুমারের মরদেহে মালা পরাতে। সেই বছরই কলকাতা বইমেলায় গিয়েছিলেন, তবে সাংবাদিকরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে যান। কেউ ফোটো তুলতে পারেনি। এর পরে ১৯৮২ সালে তাঁকে দেখা যায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে। তবে সেখানেও গোষ্ঠ কুমারের মেকআপে এসেছিলেন সুচিত্রা সেন। সেই শেষ, নিজেকে সব কিছু থেকে আলাদা করে নেন এরপরে।
জানা যায়, অন্তরাল হওয়ার বুদ্ধি সুচিত্রাকে দেন কানন দেবীও। শেখান, বাজে ছবি করে যেন অর্জিত সুনাম না নষ্ট করেন সুচিত্রা। তবে সিনেমা থেকে সরিয়ে নিলেও, অন্তরালে গেলেও এক ফোঁটা কমেনি সুচিত্রা সেনের জনপ্রিয়তা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন