এই অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে দুইজন বর্তমান ছাত্র এবং একজন প্রাক্তন ছাত্র। ভুক্তভোগী পুলিশে অভিযোগ দায়ের করার পর, কর্তৃপক্ষ তালবাগান এলাকা থেকে সন্দেহভাজনদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে। তদন্তে জানা গেছে যে প্রাক্তন ছাত্রটিকেই প্রধান অভিযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে, এবং পুলিশ অন্য দুজনের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্ত করছে।
সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে, এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সংগ্রহের জন্য একটি ফরেনসিক দল অপরাধস্থল পরীক্ষা করবে। ভুক্তভোগীকে মেডিকেল পরীক্ষার জন্য চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আশ্চর্যজনকভাবে, আরজি কর মেডিকেল কলেজের একজন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীর ধর্ষণ ও হত্যার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে, যা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বারবার ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে।
কসবা ল কলেজ প্রশাসনের নীরবতা জনসাধারণের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, কারণ কলকাতা জুড়ে জবাবদিহিতা এবং শক্তিশালী ক্যাম্পাস নিরাপত্তার দাবি আরও জোরদার হচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে খবর, ছাত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল অভিযুক্ত কলেজের প্রাক্তনী। রিলেশনশিপে থাকার কারণে অভিযুক্তের প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করেন ছাত্রী। তাঁর প্রেমিককে খুনের হুমকিও দেয় মূল অভিযুক্ত। ছাত্রীর বাবা-মাকে গ্রেফতারের ভয়ও দেখানো হয় বলে অভিযোগ। উল্লেখ্য, ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র কলেজের প্রাক্তনী।
অভিযোগপত্রে ছাত্রী আরও দাবি করেছেন যে, তাঁকে জোর করে কলেজের রুমে আটকে রাখা হয়। তারপরে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়। কলেজে নিরাপত্তারক্ষীর গার্ড রুমে অত্যাচার চালানো হয় বলে অভিযোগ। ধর্ষণের ঘটনা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা হয় বলেও দাবি করেছেন নির্যাতিতা। এই ঘটনা কাউকে জানালে ওই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকিও দেয় অভিযুক্ত।
সূত্রের খবর, পরীক্ষার ফর্ম পূরণের জন্য গত বুধবার দুপুরে কলেজে গিয়েছিলেন ওই ছাত্রী। প্রথমে কলেজের ইউনিয়ন রুমে বসেছিলেন তিনি। অভিযোগ, পরে কলেজের মেন গেট বন্ধ করতে নির্দেশ দেয় অভিযুক্ত।
পুলিশ সূত্রে খবর, মূল অভিযুক্ত ওই কলেজের প্রাক্তনী। অভিযুক্তদের ‘জে’, ‘এম’ এবং ‘পি’ নামে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। অভিযুক্ত 'এম'-এর সঙ্গে তৃণমূলের একাধিক শীর্ষ নেতৃত্বের ছবি ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি তৃণমূলের ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত বলে লেখা রয়েছে। সেখানে নিজেকে তিনি দক্ষিণ কলকাতা জেলা টিএমসিপির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া তিনি দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজের তৃণমূলের ইউনিটের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। পেশাগত দিক হিসেবে আলিপুর আদালতের 'ক্রিমিনাল লইয়ার' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এনিয়ে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নয়না চট্টোপাধ্যায় শুক্রবার সকালে বলেছেন, ‘‘আমি বিষয়টি জানতাম না। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত আমাদের ক্লাস চলে। এই ঘটনা ঘটেছে তার অনেক পরে। এখন আমি কলেজে যাচ্ছি। তার পর বিষয়টি দেখছি। তবে এই ধরনের জঘন্য ঘটনার দায় কলেজ কোনও ভাবেই এড়িয়ে যাবে না। আইন অনুযায়ী যা শাস্তি হওয়া উচিত, তার ব্যবস্থা করা হবে"।
পরে কলেজে পৌঁছে তিনি সংবাদমাধ্যমে জানান, উনি কলেজের অস্থায়ী স্টাফ। গভর্নিং বডির নির্দেশে অস্থায়ী স্টাফ হিসেবে ৬-৭ মাস ধরে আছেন। ৪৫ দিন করে করে রাখা হয়েছে। উনি এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। ল'কলেজের ডিগ্রিও আছে। সেই মত অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিল গভর্নিং বডি। কলেজের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কেন তিনি ক্যাম্পাসে ছিলেন, তা খতিয়ে দেখা হবে। পুরো বিষয়টি জিবি প্রেসিডেন্টকে জানানো হয়েছে।
এই গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শান্তা দত্ত দে বলেছেন, ‘‘আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষকে লিখিত ভাবে রিপোর্ট জমা দিতে হবে। ঘটনার পর কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে"। মঙ্গলবারের মধ্যে তথ্য অনুসন্ধান কমিটি তৈরি করা হবে। তারপরে আচার্যকে লিখিত ভাবে জানানো হবে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরও বলেন, ‘‘এটা একটা জঘন্য ঘটনা। তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। লুম্পেনদের রাজনৈতিক মদত দেওয়া হয় বলেই এই ধরনের ঘটনা কলেজগুলিতে ঘটে চলেছে। এর বিহিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যান্য কলেজেও নজরদারি বৃদ্ধি করা হবে। কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা যাতে না ঘটে, তা সুনিশ্চিত করা হবে"।
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ও যুব সংগঠনের সভাপতি সার্থক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যে অভিযুক্তদের সঙ্গে টিএমসিপির যোগের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা ছাত্র পরিষদের পদাধিকারী নন। আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি"।
সংবাদমাধ্যমে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘তৃণমূলের কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাক বা না থাক, দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপের দাবি জানাচ্ছি। যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সে বর্তমানে কলেজের কর্মচারী। ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত নয়। যদি এই ঘটনা এবং অভিযোগ সত্যি হয়, তার বিরুদ্ধে ১০০ শতাংশ আইনানুগ ব্যবস্থা যাতে নেওয়া হয় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যাতে হয়, তার জন্য তৃণমূল ছাত্র পরিষদ লড়বে"।
এদিন প্রথমে কলেজের গেটে উঠে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন ছাত্র, যুব, মহিলা কর্মীরা। এরপরে গেট টপকে ভিতরে প্রবেশ করে মমতা এবং অভিষেকের ফ্লেক্স ছিঁড়ে ফেলেন বিক্ষোভকারীরা। বিজন সেতু থেকে মিছিল আন্দোলনকারীরা কসবা থানা পর্যন্ত আসেন। সেখানে মিছিল পৌঁছাতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এসএফআই, ডিওয়াইএফআই কর্মীদের ওপর বিক্ষোভ চলাকালীন লাঠি চালায় পুলিশ। একাধিক ছাত্র, যুব, মহিলা কর্মীরা আহত হয়েছেন। জানা গেছে, এখনও পর্যন্ত তিনজনকে আটক করে রাখা হয়েছে কসবা থানায়। বাকিদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে লালবাজারে। অন্যদিকে, এই বিক্ষোভে উপস্থিত হন অভয়া মঞ্চের সদস্যরাও। তারাও বাম ছাত্র যুব কর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভে সামিল হন।
সাউথ ক্যালকাটা ল'কলেজে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে, বিভিন্ন দেওয়ালে নীল-সাদা রঙে লেখা 'টিম এমএম'। কোথাও আবার চোখে পড়বে 'মনোজিৎ দাদা তুমি আমাদের হৃদয়ে আছ'। সব জায়গাতেই লেখা, 'দক্ষইণ কলকাতা তৃণমূল কংগ্রেস'। খুব কাছের মানুষের কাছে এই মনোজিৎ পরিচিত 'ম্যাঙ্গো' নামে। পড়ুদের ভর্তি থেকে শুরু করে কলেজ ইউনিয়নের কে কোন পদে বসবেন, সবই চলত মনোজিতের ইচ্ছের উপর। এমনকী, অনেক সময়েই কোন শিক্ষক কখন-কোন ক্লাস নেবে, তা-ও অনেক সময়ে ঠিক করে দিত ম্যাঙ্গোই। কলেজের কর্মী থেকে অধ্যক্ষ, সবাই নাকি থাকত তার হাতের মুঠোয়। কোন শিক্ষককে ঘেরাও করা হবে, কার গাড়ি ভাঙচুর করা হবে, তা-ও হত ম্যাঙ্গোর ইশারাতেই। এমনটাই জানা গিয়েছে কলেজ পড়ুয়াদের সূত্রে।
কালীঘাট মন্দির চত্বরে বাড়ি মনোজিৎ মিশ্রর। তার দাপটে নাকি পাড়ার লোকও শিঁটিয়ে থাকেন। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালে প্রথমবার কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে। এক বছরের মধ্যে কলেজে ছুরি মারার অভিযোগে থানায় অভিযোগ দায়ের হয় তার নামে। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর কলেজ যায়নি সে। ২০১৪ সালে তাকে ডিসকলেজিয়েট করে দেওয়া হয়। প্রথম থেকেই TMCP করত মনোজিৎ। ছিল ইউনিট প্রেসিডেন্টও। তারপর ২০১৭ সালে ফের সাউথ ক্যালকাটা ল'কলেজে ভর্তি হয় ম্যাঙ্গো। সে বছরই সিসিটিভি ভাঙচুরের ঘটনায় নাম জড়ায় তার। একাধিকবার সাসপেন্ডও করা হয় মনোজিৎকে। সূত্রের খবর, ওই কলেজের প্রয়াত প্রিন্সিপাল দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারও করা হয় তাকে। ২০২১ সালে পাশ করলেও কলেজ ছেড়ে যায়নি। একাধিক ঝামেলা-গোলমালে নাম জড়িয়েছে তার। এই কলেজে একচ্ছত্র ক্ষমতা দখল করে বসেছিল। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে তার ছবির জেরে চমকে রাখত জুনিয়রদের। কলেজ এবং বাইরের একাধিক তরুণীকে হেনস্থা ও উত্যক্ত করার অভিযোগও রয়েছে তার নামে।
অভিযুক্তের আইনজীবী সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করলেন
“২৬ জুন নির্যাতিতা যে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন, তার ভিত্তিতেই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” জানান কলকাতা পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার। মিশ্রর আইনজীবী আজম খান বলেন, তাঁর মক্কেল এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন।
“আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে এই সমস্ত অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণেই তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে,” দাবি করেন খান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন