Top News

ভারতের জাতিভিত্তিক বৈষম্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:

মার্চের ১২ তারিখে আমাদের রাজ্যের পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া সাব-ডিভিশনে অবস্থিত গিধগ্রামের দাসপাড়ায় দলিত সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ৩০০ বছর পর গিধেশ্বর শিব মন্দিরে প্রবেশ করেন।


ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, বিষয়টি এক দিক থেকে ইতিহাস; গর্বের বিষয়। কারণ সমাজের নিম্নস্থানে থাকা অবহেলিত, অত্যাচারিত, অসহায় কিছু মানুষ বহু দিনের সামাজিক বাঁধা, বিপত্তির গণ্ডি ডিঙিয়ে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পেরেছে। আবার অন্যদিকে, এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়— আমাদের এই সমাজ কতটা নিষ্ঠুর, নির্লজ্জ, অমানবিক ও বর্বর। কারণ এই সমাজ— অর্থাৎ আপনি, আমি, আমাদের আশেপাশে থাকা বেশিরভাগ মানুষ— সেই সমস্ত দলিতদের উপর দুর্ব্যবহার, অবিচার, অন্যায় করে চলেছি বা হতে দিচ্ছি। দেখেও না দেখার অভিনয় করে চলেছি। কখনও তাদের হয়ে আওয়াজ তুলিনি।

দাসপাড়ার পাঁচজন— তাদের মধ্যে চারজন মহিলা এবং একজন পুরুষ, ১৩০টি পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করে সকাল ১০টা নাগাদ মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং শিবলিঙ্গের ওপর দুধ ও জল ঢেলে পূজা করেন। বিষয়টি শুনতে যতটা সহজ, সরল মনে হচ্ছে, বাস্তবে তা মোটেও সহজ ছিল না। গ্রামের দলিত লোকেরা মন্দিরে প্রবেশের বিষয়ে গ্রামের প্রবীণ ও মন্দির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যর্থ হন। এমনকি শিবরাত্রির দিন তারা এই প্রথা ভাঙার চেষ্টা করলে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন। তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। তাদের পালিত গবাদি পশুর দুধ বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ভাবুন, বিষয়টি কতটা গুরুতর! আমাদের সমাজ এখনো এই প্রথার সমর্থন করছে, তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা মন্দিরে প্রবেশে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। একাধিক আলোচনার পর SDO Ahimsa Jain এর নেতৃত্বে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্থানীয় বিধায়ক, পুলিশ আধিকারিক ও মন্দির কর্তৃপক্ষ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, প্রত্যেকেই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে— কারণ প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকার আছে।

চলুন, এই আলোচনার মাধ্যমে জেনে নেওয়া যাক—জাতি-বর্ণ বৈষম্য কী? কবে থেকে এই প্রথার শুরু? কেন শুরু হলো? কে বা কারা শুরু করল? কে বা কারা এই প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল? কীভাবে শুরু হলো? এই প্রথার ফলাফল কী? সরকার কি তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? নাকি তারা সরকারের কাছেও অবহেলিত হয়েছিল?

Apastamba Dharmasutra (The Apastamba Dharmasutra is a Sanskrit text, one of the oldest surviving Dharma-post Vedic Smriti texts in Hinduism) অনুযায়ী, যদি কোনো উচ্চ জাতির মানুষ একজন দলিত জাতির মানুষের সংস্পর্শে আসে, কথা বলে, বা যদি কখনও চোখাচোখি হয়ে যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে স্নান করে, ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলে, সূর্য, চাঁদ বা তারা দেখে নিজেকে শুদ্ধ করতে হয়। এমনকি তাদের ছায়াকেও দুষিত মনে করা হতো। তামিলনাড়ুতে শামার (Shamar) জাতির লোকদের ব্রাহ্মণদের থেকে ২৮ পা এবং কেরালায় তিয়ান (Tiyyans) জাতির লোকদের ৩৬ পা দূরে থাকার আদেশ ছিল। শুধু তাই নয়, জাতির ভিত্তিতে দলিতদের সঙ্গে বাসস্থান-ভিত্তিক বৈষম্য দেখা গেছে। তাদের গ্রাম থেকে সরিয়ে অস্বাস্থ্যকর, অপরিচ্ছন্ন স্থানে বসবাসে বাধ্য করা হয়েছে। বহু জায়গায় মন্দিরের মতো পবিত্র স্থানে তাদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। উচ্চ জাতির বসবাসকারী গ্রামে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি উচ্চ জাতির মানুষেরা যেসব অলংকার, পোশাক পরতেন, সেগুলো দলিতদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কেরালার ইরাভা (Irava) মহিলাদের শরীরের ওপরের অংশে পোশাক পরার অধিকার ছিল না। কিছু ধর্মীয় গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা করে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জাতিভেদকে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রচার করা হয়েছে। আর যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করত, তাদের ওপর চলত বহিষ্কার, হত্যা, হিংসা বা সহিংসতা এবং বিচার ছাড়াই গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করার মতো নৃশংস অত্যাচার। বর্ণ এবং জাতির প্রাক-ঐতিহাসিক উৎস থাকলেও বর্তমানে জাতি-বর্ণের যে ব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মুঘল সাম্রাজ্যের পতন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। জাতিভিত্তিক বৈষম্য মূলত তৈরি হয়েছিল কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার লালসা থেকে। সমাজের উচ্চস্থানে থাকা কিছু লোভী, স্বার্থপর মানুষ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ, কাজের বিভাজন ও অর্থনৈতিক শোষণের সুবিধা নেওয়ার জন্য এই প্রথা গ্রহণ করেছিলেন। যার ফলে সামাজিক বৈষম্য, যেমন— উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মধ্যে বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। অনেক মানুষ শিক্ষা, সম্মান এমনকি মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। নিম্নবর্ণের (বিশেষ করে দলিত) মানুষরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম গরিব থেকে গেছে, কারণ তাদের জমি, শিক্ষা বা ভালো চাকরির সুযোগ দেওয়া হয়নি। অনেক দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষ মারধর, হত্যা, সামাজিক বয়কট ও চরম অপমানের শিকার হয়েছে। বৈষম্যের কারণে অনেক মেধাবী মানুষ কখনোই পড়াশোনা বা সমাজের উন্নয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি। সমাজ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বদলে বিভাজন ও ঘৃণায় ভরে উঠেছে, যা দেশের শক্তিকে দুর্বল করেছে। অনেক নিম্নবর্ণের মানুষ ভয় ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন।

আনুমানিক ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বের কাছাকাছি প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘ঋগ্বেদ’ অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্বের প্রথম মানুষ নিজেকে উৎসর্গ করে এই সমাজ সৃষ্টি করেন। তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে চারটি ভিন্ন জাতি— যাদের একত্রে ‘বর্ণ’ (Varna) বলা হয়। তাঁর মাথা থেকে সৃষ্টি হয় ব্রাহ্মণ জাতি, যারা ছিলেন জ্ঞানী ও সমাজের উচ্চপদস্থ কাজে নিযুক্ত। বাহু থেকে সৃষ্টি হয় ক্ষত্রিয় জাতি, যারা ছিলেন শাসক ও যোদ্ধা। উরু থেকে সৃষ্টি হয় বৈশ্য জাতি— কারিগর, ব্যবসায়ী ও কৃষক। পা থেকে সৃষ্টি হয় শূদ্র জাতি, যারা শ্রমঘন কাজ করতেন। এই ‘বর্ণ’ চারটির বাইরেও ছিল আরেকটি শ্রেণি— উপজাতি ও অস্পৃশ্য, যাদের বলা হতো ‘অবর্ণ’ (Avarna)। তাদের দিয়ে সমাজের সবথেকে নিচুস্তরের কাজ করানো হতো।

প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে এই বর্ণব্যবস্থা ধীরে ধীরে জন্মনির্ভর হয়ে ওঠে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিচু জাতির মানুষ ‘নীচু’ বা ‘অস্পৃশ্য’ বলে বিবেচিত হতে থাকে। ১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ভারতে আসে। পরে ধীরে ধীরে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে ব্রিটিশরা ভারতে শাসন শুরু করে। এই সময় ব্রিটিশরা ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য জাতি ও বর্ণ ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। উচ্চ পদে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের মানুষদের নিয়োগ দেওয়া হতো, আর দলিত, উপজাতি ও অস্পৃশ্যদের দেওয়া হতো নিম্নপদস্থ কাজ। এর ফলে কিছু দলিতের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও সামাজিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

বহু সময় ধরে বহু সমাজসংস্কারক জাতি-বর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন— যেমন রাজা রামমোহন রায়, আত্মারাম পাণ্ডুরঙ্গন, পরমহংস মণ্ডলীর দুর্গারাম মেহতা ও দাদোবা পাণ্ডুরং। বিশেষ করে জ্যোতিরাও ফুলে, যিনি ব্রাহ্মণদের বহিরাগত বলেন এবং তাদের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন, জাতিভিত্তিক বৈষম্য, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রচার করেন। মহাত্মা গান্ধী দলিতদের জন্য কাজ করেন, ১৯৩২ সালে “হরিজন সেবক সংঘ” প্রতিষ্ঠা করেন। ড. বি. আর. আম্বেদকর, যিনি নিজে একজন দলিত, সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে একজন মহৎ মানবাধিকার নেতা হন এবং ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান রচনা করেন। ১৯৩২ সালে তিনি দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা দাবি করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড তাতে সম্মতি দিলে মহাত্মা গান্ধী তীব্র প্রতিবাদ করেন, কারণ তিনি মনে করতেন, এতে হিন্দু সমাজ ভেঙে যাবে। এর ফলে ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ‘পুনা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধানে Scheduled Castes (SCs), Scheduled Tribes (STs) এবং পরবর্তীতে Other Backward Classes (OBCs) এর জন্য সংরক্ষণ আইন পাশ হয়।

ভারত সরকার দলিতদের উন্নয়নের জন্য নানান ব্যবস্থা গ্রহণ করে— সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় সংরক্ষণ, আর্থিক সহায়তা, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, আইনগত সুরক্ষা ইত্যাদি। ১৯৮৯ সালে পাশ হয় SC/ST Atrocities Act এবং ১৯৯৩ সালে মানবাধিকার সুরক্ষা আইন। পরে সময়ের সাথে এই আইনগুলো আরও শক্তিশালী করা হয়।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ও স্বাস্থ্যগত নানা সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু আজও দেশের অনেক গ্রাম, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সম্পর্ক, এমনকি বিচার ব্যবস্থায়ও জাতপাতের আধারে বৈষম্য বজায় আছে। এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত নানা ঘাটতি। অর্থাৎ সভ্যতার আলো সমাজে প্রবেশ করলেও মানুষের চিন্তা-চেতনার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সেই কারণেই ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে শুরু হওয়া বৈষম্য আজও বর্তমান। সুতরাং জাতি-বর্ণ ভিত্তিক এই প্রথা বন্ধ করতে হলে প্রথমেই মানুষের চিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। নিঃস্বার্থভাবে ভাবতে হবে, মানবিক হতে হবে। তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে শুধু সরকার নয়, বরং এই সমাজকেও সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন