ভারতীয় দাবার
সেরা দিব্যা দেশমুখ ইতিহাসে নিজের নাম খোদাই করে ফেললেন ২০২৫ সালের ফাইড মহিলা বিশ্বকাপে
জয় ছিনিয়ে নিয়ে। জর্জিয়ার বাটুমি শহরে ৫ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত
হওয়া এই প্রতিযোগিতার সর্বভারতীয় ফাইনালে তিনি কিংবদন্তি গ্র্যান্ডমাস্টার হাম্পি
কোনেরুকে হারিয়ে শিরোপা জয় করেন। ১৯ বছর বয়সী দিব্যার এই অসাধারণ সাফল্য শুধুমাত্র
তাঁকে চ্যাম্পিয়নই করেনি, বরং তাঁকে ভারতের ৮৮তম গ্র্যান্ডমাস্টার এবং সর্বকনিষ্ঠ
মহিলা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
গৌরবময় পথচলা: দিব্যার দুর্দান্ত অভিযান
২০ সিডের মধ্যে
১৫তম স্থান (ফাইড রেটিং: ২৪৬৩) নিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করলেও, দিব্যার জয় কোনও দুর্ঘটনা
ছিল না। একের পর এক প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন ও উচ্চ রেটিংধারী খেলোয়াড়কে হারিয়ে তিনি
দেখিয়ে দেন যে তার মধ্যে নিখুঁত কৌশল, আক্রমণাত্মকতা ও সাহসের অপূর্ব মিশেল আছে।
দিব্যার
মূল ম্যাচগুলি:
- রাউন্ড ৬৪: মেরি আরাবিদজে (জর্জিয়া)
কে হারান
- রাউন্ড ৩২: তেওদোরা ইনজ্যাক (সার্বিয়া)
কে হারান
- রাউন্ড ১৬: আলেকজান্দ্রা গরিয়াচকিনা
(ফাইড) কে হারান
- কোয়ার্টার ফাইনাল: ভাইশালী রমেশবাবু
(ভারত) কে হারান
- সেমি ফাইনাল: ঝু জিনার (চীন) কে
হারান
- ফাইনাল: কোনেরু হাম্পি (ভারত) কে
হারান
গ্র্যান্ডমাস্টার
অনিশ গিরি বলেছেন, “তাঁর আক্রমণাত্মক খেলা, টাইব্রেকারে স্থিরতা ও টাইম প্রেসারে নিখুঁত
ক্যালকুলেশন তাঁকে একটি প্রজন্মের প্রতিভা হিসেবে তুলে ধরে।”
ফাইনালে ৩৮
বছর বয়সী অভিজ্ঞ কোনেরু হাম্পির বিরুদ্ধে দিব্যা ক্লাসিকাল গেমে ১-১ ড্র করার পর র্যাপিড
টাইব্রেকে ১.৫-০.৫ ব্যবধানে জয়ী হয়ে ফাইনাল স্কোর ২.৫-১.৫ করেন।
কে দিব্যা দেশমুখ?
নাগপুরে জন্ম
নেওয়া দিব্যা বরাবরই এক প্রতিভাবান দাবাড়ু হিসেবে পরিচিত। ২০২২ সালে তিনি জাতীয়
মহিলা চ্যাম্পিয়ন হন এবং ২০২৩ সালে এশিয়ান কন্টিনেন্টাল চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেন।
তাঁর আক্রমণাত্মক স্টাইল এবং গভীর প্রস্তুতি তাঁকে দর্শকদের প্রিয় করে তোলে।
বিশ্বকাপের
পূর্ববর্তী কীর্তি:
- ২০২১: ফাইড অনলাইন অলিম্পিয়াডে
স্বর্ণ (ভারতীয় দল)
- ২০২৩: এশিয়ান কন্টিনেন্টাল সিলভার
- ২০২৪: টাটা স্টিল ইন্ডিয়া উইমেন
র্যাপিড চ্যাম্পিয়ন
- ২০২৫: ফাইড মহিলা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন
তিনি বর্তমানে
মুম্বইয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার পাশাপাশি গ্র্যান্ডমাস্টার অভিজিৎ কুনতের অধীনে
কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঐতিহাসিক সর্বভারতীয় ফাইনাল
২০২৫ সালে প্রথমবার
মহিলা বিশ্বকাপে একটি সর্বভারতীয় ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। এই ফাইনালটি ভারতীয় দাবার আধিপত্য
এবং উত্তরসূরীদের উত্থানকে চিহ্নিত করে। হাম্পি বলেছেন, “ও এক কল্পনার ফল। ভারতের ভবিষ্যৎ
অত্যন্ত উজ্জ্বল।”
এই ফাইনাল সামাজিক
মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলিতেও শিরোনাম হয়।
ফাইনালের
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
গেম |
ফলাফল |
বিজয়ী |
ক্লাসিকাল
১ |
০.৫ - ০.৫ |
ড্র |
ক্লাসিকাল
২ |
০.৫ - ০.৫ |
ড্র |
র্যাপিড
১ |
০.৫ - ০.৫ |
ড্র |
র্যাপিড
২ |
১ - ০ |
দিব্যা |
ভারতীয় ফাইনালিস্টদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
দিব্যা দেশমুখ
(ভারত)
- বয়স: ১৯
- রেটিং: ২৪৬৩
- শক্তি: আক্রমণাত্মক মিডল গেম, র্যাপিড
খেলায় দৃঢ়তা
হাম্পি কোনেরু
(ভারত)
- বয়স: ৩৮
- রেটিং: ২৫৪৩
- কৃতিত্ব: প্রাক্তন বিশ্ব ২ নম্বর,
২০১৯ বিশ্ব র্যাপিড চ্যাম্পিয়ন
- স্টাইল: পজিশনাল প্লে ও এন্ডগেমে
পারদর্শী
ভারতের দাবা জাগরণ: ফাইড-এর সহায়তায় নতুন প্রতিভার
উত্থান
ফাইড এবং এআইসিএফ-এর
অব্যাহত সহায়তা, প্রাইজ মানি বৃদ্ধি ও কোচিং প্রোগ্রামের কারণে ভারতের মহিলা দাবায়
নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। বৈশালী, ভান্তিকা, এবং সবিতা শ্রীসহ ভারতের তরুণ প্রজন্ম
বিশ্বমঞ্চে নিজেদের জানান দিচ্ছে।
সিএফআই প্রেসিডেন্ট
ভারত সিং চৌহান বলেন:
“ফাইড-এর নারীকেন্দ্রিক ক্যালেন্ডার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলশ্রুতি দিব্যার এই
জয়।”
ভারতীয় মহিলা দাবায় নারী শক্তির উত্থান
ভারতের ৬ জন
মহিলা খেলোয়াড় এই বিশ্বকাপে অংশ নেন – যা রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনও দেশের চেয়ে বেশি।
দিব্যা ও হাম্পির সঙ্গে যাঁরা নজর কেড়েছেন:
- হারিকা দ্রোণাভল্লি – কোয়ার্টার
ফাইনাল
- বৈশালী – শেষ ষোলো
- ভান্তিকা আগরওয়াল – তৃতীয় রাউন্ড
- সবিতা শ্রী – দ্বিতীয় রাউন্ড
টুর্নামেন্ট ওভারভিউ: বাটুমিতে দাবার মহাযুদ্ধ
৫-২৯ জুলাই
পর্যন্ত ১০৭ জন খেলোয়াড়, ৪৬টি দেশ, ৭টি রাউন্ড - বাটুমির ফাইড মহিলা বিশ্বকাপ ছিল
এক ঐতিহাসিক আসর। অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট দাবাড়ুদের মধ্যে ছিলেন:
- লেই টিংজি (চীন) – ২৫৫২
- ট্যান ঝংই (চীন) – ২৫৪৬
- আন্না মুজিচুক (ইউক্রেন)
- কাতেরিনা লগনো (ফাইড)
- আলেক্সান্দ্রা কস্তেনিউক (সুইজারল্যান্ড)
তবে শেষ হাসি
ভারতেরই - কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছানো তিনজন ভারতীয় মহিলা দাবাড়ুই প্রমাণ করলেন ভারতের
শাসন।
রেকর্ড ও পরিসংখ্যান
- মোট অংশগ্রহণকারী: ১০৭
- দেশ: ৪৬
- ভারতের ফাইনালিস্ট: প্রথমবার
- সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়ন: দিব্যা
দেশমুখ (১৯)
- অর্জিত খেতাব: গ্র্যান্ডমাস্টার
(৮৮তম ভারতীয়)
- সর্বোচ্চ রেটিংধারী বাদ: GM জু ওয়েনজুন
(চীন, রাউন্ড ৪)
- প্রাইজ পুল: $৬৯১,২৫০
ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের দিকে পরবর্তী নজর
এই সাফল্যের কারণে দিব্যা সরাসরি ২০২৬ সালের ফাইড মহিলা ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে নিজের যোগ্যতাসম্পন্ন করেছেন। হাম্পিও প্রবেশের সম্ভাবনায় রয়েছেন। আগামী আসর অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, যেখানে আগে থেকেই লেই টিংজি, গরিয়াচকিনা ও ট্যান ঝংই অংশ নিচ্ছেন।
ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়
দিব্যার এই জয় শুধুমাত্র একক সাফল্য নয়, বরং এটি ভারতীয় মহিলা ক্রীড়ার জন্য একটি মাইলফলক। তাঁর বিজয় ছবি, জাতীয় পতাকার সঙ্গে, এখন ছোট শহরের মেয়েদের স্বপ্নের প্রতীক।
২০২৫ ফাইড মহিলা বিশ্বকাপ: মূল দিকগুলো
- দিব্যা দেশমুখ: সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয়
মহিলা বিশ্বকাপ বিজয়ী, ৮৮তম গ্র্যান্ডমাস্টার
- ভারতীয় আধিপত্য: ৩ জন কোয়ার্টার
ফাইনালে
- বাটুমি আবার ভারতের জন্য সৌভাগ্যের
স্থান
- দিব্যা বনাম হাম্পি: প্রজন্মান্তরের
প্রতীক
- দিব্যা: ভবিষ্যতের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের
সম্ভাব্য মুখ
বিশ্বজুড়ে অভিনন্দন
- বিশ্বনাথন আনন্দ: “চমৎকার খেলেছে
দিব্যা! ভবিষ্যতের তারকা।”
- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি: “দিব্যার
ঐতিহাসিক জয় দেশকে অনুপ্রাণিত করবে।”
- ম্যাগনাস কার্লসেন: “পুরো ইভেন্ট
না দেখলেও ফাইনাল ছিল অসাধারণ। অভিনন্দন দিব্যা!”
দিব্যা দেশমুখ: বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নের মুকুটে
নবজাগরণের বার্তা
এই জয় শুধুমাত্র
একটি টুর্নামেন্টের শিরোপা নয় - এটি এক আন্দোলন। এক নতুন ভারতীয় দাবার যুগ, যেখানে
নারী প্রতিভা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জ্বলজ্বল করছে। ফাইড ও এআইসিএফ-এর কাঠামোগত সহায়তায়
দিব্যা এখন বিশ্বের অন্যতম উজ্জ্বল নাম।
তিনি শুধু ভারতের
দাবার নতুন রানি নন - তিনি বিশ্ব দাবার ভবিষ্যৎ সম্রাজ্ঞী।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন