ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের এক বছরের চিত্র ভয়াবহ
এক বছর আগে আজকের এই দিনেই শেষ হয় দীর্ঘ একদলীয় শাসনের অধ্যায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ক্ষমতাচ্যুত হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। মানুষ উদ্দীপ্ত হয়েছিল নতুন স্বপ্নে— এক দুর্নীতিমুক্ত, সহিংসতাহীন, মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশায়। ‘বাংলাদেশ ২.০’— এই স্লোগানে শুরু হয়েছিল এক নতুন সময়ের সূচনা।
কিন্তু আজ, সেই নতুন বাংলাদেশের এক বছর পূর্তিতে প্রশ্ন উঠছে— এই পরিবর্তন কি সত্যিই স্বপ্নপূরণ করেছে, না কি খুলে দিয়েছে আরেকটি দুঃস্বপ্নের দরজা?
এই এক বছরে নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা যে হারে বেড়েছে, তা সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার কর্মীদের দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা— এই ত্রিফলা আঘাতে সমাজে তৈরি হয়েছে নৈরাজ্যকর পরিবেশ। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত নারী নির্যাতন সংশ্লিষ্ট মামলার সংখ্যা ছিল ৬,১৪৪টি। শুধু ধর্ষণের ঘটনাই ছয় মাসে কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে।
• জানুয়ারি ২০২৫: ধর্ষণ মামলা ৩৯২টি
• জুন ২০২৫: ধর্ষণ মামলা ৪৯২টি
আইন ও সালিশ কেন্দ্র -এর তথ্যমতে, শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৫৮ জন নারী ও কিশোরী, যার মধ্যে ২৮৪ জনই ছিল শিশু (১৮ বছরের নিচে)।
• ৪০ জন নারী ধর্ষণের পর নিহত হন
• ১১ জন আত্মহত্যা করেন
• ২৩% ধর্ষণ ছিল গ্যাং রেপ
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে রেকর্ড হয় ৩৯টি ধর্ষণ মামলা, ফেব্রুয়ারিতে ৪৬টি, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু।
জুন ২০–২৯ তারিখ পর্যন্ত মাত্র ৯ দিনেই ২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, যাকে The Logical Indian “pandemic-level crisis” হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এই পরিসংখ্যান সমাজের ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে ধরে, যেখানে নারীর নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করছে।
চাঁদাবাজি সংক্রান্ত নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সীমিত হলেও, বাস্তব চিত্র ভয়াবহ। বিশেষ করে সংখ্যালঘু ব্যবসায়ী ও পরিবারগুলোর ওপর নিয়মিতই আর্থিক নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে— হুমকি, জমি দখল, মন্দির বা দোকানে হামলা এবং অর্থ আদায়ের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ (BHBCUC) জানিয়েছে, গত এক বছরে অন্তত ১১টি সংগঠিত চাঁদাবাজির ঘটনা তাদের নজরে এসেছে, যার মধ্যে বেশ কিছু ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবে অপরাধীরা অনেকক্ষেত্রেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঠিক পরপরই সহিংসতার ঢেউ বয়ে যায় সংখ্যালঘুদের ওপর। মাত্র ১৫ দিনে (৫–২০ আগস্ট) দেশে ঘটে ২,০১০টি হামলার ঘটনা।
• আক্রান্ত ৬৯টি মন্দির
• আক্রান্ত ১৫৭টি সংখ্যালঘু পরিবার
• নিহত কমপক্ষে ৫ জন
অগাস্ট ৫–২০, ২০২৪ পর্যন্ত মাত্র ১৬ দিনের ব্যবধানে ৪৯টি জেলায় ঘটেছে ১,০৬৮টি হামলা, যার মধ্যে ৯১২টি ঘটনা প্রামাণ্যভাবে নথিভুক্ত হয়েছে।
বিভাগভিত্তিক সর্বোচ্চ আক্রান্ত অঞ্চল:
• খুলনা: ~২৯৫টি ঘটনা
• রংপুর: ~২১৯টি
• ময়মনসিংহ: ~১৮৩টি
• রাজশাহী: ~১৫৫টি
• ঢাকা বিভাগে প্রায় ৭৯টি হামলা।
নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল ৫ আগস্ট ২০২৪-এ। আজ এক বছর পর দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্ন যেন সহিংস বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন ও বিশ্লেষকদের মতে, প্রশাসনের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক প্রতিশোধপরায়ণতা এবং আইনশৃঙ্খলার দুর্বল ব্যবস্থাপনাই এই চিত্রের পেছনে মূল কারণ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন