রাজগিরে গর্বিত ভারত
পুরুষদের হকি
এশিয়া কাপ ২০২৫ শুধু একটি মহাদেশীয় টুর্নামেন্টই ছিল না, এটি ছিল ভারতীয় হকির জন্য
এক প্রতীকী প্রত্যাবর্তন। ২৯ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিহারের রাজগিরে অনুষ্ঠিত
এই প্রতিযোগিতা ছিল ২০২৬ সালের এফআইএইচ পুরুষদের হকি বিশ্বকাপের (বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস)
যোগ্যতা অর্জনের লড়াইও। প্রাক-টুর্নামেন্টেই ভারত ছিল অন্যতম ফেভারিট, তাদের শক্তি
ও সাম্প্রতিক ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের কারণে।
গ্রুপ পর্বে দুর্দান্ত সূচনা
গ্রুপ পর্বেই
আক্রমণাত্মক ক্ষমতা দেখায় ভারত। কাজাখস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ভারত ১৫-০ গোলের
রেকর্ড জয় তুলে নেয়। এর ফলে গোল ব্যবধানেও এগিয়ে যায় তারা। এরপর চীনের বিপক্ষে
ভারত জেতে ৬-০ গোলে। তবে জাপানের বিপক্ষে ম্যাচটা কঠিন হয়। শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলে ড্র
করে ভারত। যদিও এ ম্যাচে ভারতীয় রক্ষণভাগের কিছু দুর্বলতা ধরা পড়ে, তবে চাপ সামলে
ওঠার মানসিক শক্তি প্রদর্শন করে দল।
সুপার ফোরে ধারাবাহিক ভারত
গ্রুপে শীর্ষে
থেকে সুপার ফোরে প্রবেশ করে ভারত। এখানে ধারাবাহিকতা ছিল মূল চাবিকাঠি। চীনকে ৭-০ গোলে
ও মালয়েশিয়াকে ৪-১ গোলে হারায় তারা। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে আবারও ২-২ গোলে ড্র
করে ভারত। তবুও ১০ গোল ব্যবধানের সুবাদে তারা টেবিলে শীর্ষে থাকে এবং ফাইনালে ওঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী
দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে।
ফাইনালে কোরিয়াকে হাড়িয়ে দিল ভারত
৭ সেপ্টেম্বর
রাজগির হকি স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি হয় ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। গ্যালারিতে ছিল
ত্রিবর্ণের ঢেউ আর হাজারো সমর্থকের চিৎকার। শুরু থেকেই স্বপ্নের মতো খেলতে থাকে ভারত।
প্রথম মিনিটেই সুকজিত সিং মাঠ গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। ২৮তম মিনিটে দিলপ্রীত সিং স্কোর
বাড়ান। তৃতীয় কোয়ার্টারে আসে ম্যাচের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। ৫০তম মিনিটে অমিত রোহিদাসের
দুর্দান্ত ড্র্যাগ-ফ্লিকে ভারত ৪-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। শেষ দিকে কোরিয়া একটি সান্ত্বনার
গোল তুললেও ম্যাচ শেষ হয় ভারতের ৪-১ জয়ে। এর মাধ্যমে ভারত শুধু শিরোপাই জিতল না,
সরাসরি নিশ্চিত করল ২০২৬ বিশ্বকাপে তাদের আসন।
চ্যাম্পিয়ন ভারতের প্রাপ্য পুরস্কার
ফাইনাল শেষে পুরস্কার বিতরণী ছিল ভারতের আধিপত্যের প্রমাণ।
ফাইনাল স্ট্যান্ডিংস:
১. ভারত – চ্যাম্পিয়ন
২. দক্ষিণ কোরিয়া – রানার্স আপ
৩. মালয়েশিয়া – তৃতীয়
৪. চীন – চতুর্থ
ব্যক্তিগত
পুরস্কার:
- সেরা খেলোয়াড়: অভিষেক নাইন (ভারত)
- সেরা গোলরক্ষক: কিম জে-হিয়ন (দক্ষিণ
কোরিয়া)
- সেরা তরুণ খেলোয়াড়: অ্যান্ডি জেফেরিয়ান
(মালয়েশিয়া)
- সর্বোচ্চ গোলদাতা: আখিমুল্লাহ আনোয়ার
(মালয়েশিয়া, ১২ গোল)
পুরো টুর্নামেন্টে মোট ১৬৪ গোল হয়েছিল, ম্যাচ প্রতি গড় ৬.৮৩ গোল। আক্রমণাত্মক হকির ঐতিহ্যের প্রতিফলন ছিল এটি।
হাংঝৌতে নারীদের চ্যালেঞ্জ
পুরুষদের জয়ের
পর নজর ঘুরে যায় চীনের হাংঝৌতে, যেখানে ৫ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়
মহিলাদের এশিয়া কাপ ২০২৫। ভারতীয় নারী দলের লক্ষ্য ছিল দ্বিগুণ, শিরোপা জেতা এবং
২০২৬ মহিলাদের বিশ্বকাপে সরাসরি যোগ্যতা অর্জন।
দুর্বল দলের বিপক্ষে ঝড়ো জয়
প্রথম ম্যাচেই
থাইল্যান্ডকে ১১-০ গোলে হারায় ভারত। এরপর সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে জয় আসে ১২-০ ব্যবধানে।
মুমতাজ খান ও নবনীত কউরের গোল ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে জাপানের বিপক্ষে ম্যাচে ধাক্কা
খায় দল। শেষ পর্যন্ত ২-২ ড্রয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
সুপার ফোরে কঠিন পরীক্ষা
সুপার ফোরে
প্রবেশের পর কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছিল ভারতের সামনে। জাপানের বিপক্ষে ১-১ ড্রয়ের
পর চীনের কাছে হেরে বসে ১-৪ গোলে। রক্ষণভাগে দুর্বলতা স্পষ্ট ছিল। তবে রানার্স আপ হয়েও
ফাইনালে ওঠে ভারত।
ফাইনালে চীনের কাছে স্বপ্নভঙ্গ
১৪ সেপ্টেম্বর
ফাইনালে স্বপ্নের সূচনা করে ভারত। প্রথম মিনিটেই নবনীত কউর পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল
করে এগিয়ে দেন দলকে। কিন্তু চীনের দৃঢ়তা ভারতকে চাপে ফেলে। দ্বিতীয় কোয়ার্টারে
উ জিক্সিয়া সমতা ফেরান, এরপর লি হং গোল করে চীনকে এগিয়ে দেন। শেষ কোয়ার্টারে মেইরং
জো ও ঝং জিয়াকি গোল করলে ভারত ৪-১ ব্যবধানে হেরে যায়। ফলে রানার্স আপ হয় ভারত।
রানার্স-আপ ভারতের অর্জন
ফাইনাল স্ট্যান্ডিংস:
১. চীন – চ্যাম্পিয়ন
২. ভারত – রানার্স আপ
৩. জাপান – তৃতীয়
৪. দক্ষিণ কোরিয়া – চতুর্থ
ব্যক্তিগত
পুরস্কার:
- সেরা খেলোয়াড়: মেইরং জো (চীন,
১১ গোল)
- সেরা গোলরক্ষক: সাভিতা পুনিয়া
(ভারত)
- সেরা তরুণ খেলোয়াড়: আকোনে শিবাতা
(জাপান)
- সর্বোচ্চ গোলদাতা: মেইরং জো (চীন,
১১ গোল)
মোট ১৭৩ গোল হয়েছিল এই টুর্নামেন্টে, ম্যাচ প্রতি গড় ৬.১৮। ভারতের আক্রমণভাগ প্রশংসনীয় হলেও রক্ষণে দুর্বলতা ও মানসিক দৃঢ়তার অভাব বড় শিক্ষা হয়ে দাঁড়াল।
দুই অভিযানের তুলনা
ভারতের পুরুষ ও নারীদের অভিযানের তুলনা করলে স্পষ্ট হয় পার্থক্য। পুরুষরা ফেভারিট হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাদের রক্ষণভাগ ছিল মজবুত, পেনাল্টি কর্নার কনভার্সন ছিল কার্যকর। নারীরা দুর্দান্ত সূচনা করলেও ফাইনালে চীনের শৃঙ্খলিত রক্ষণভাগ ও ধারালো আক্রমণের সামনে টিকতে পারেনি। তবুও তাদের রানার্স আপ অর্জন ঐতিহাসিক এবং বিশ্বকাপের জন্য সরাসরি টিকিট এনে দিয়েছে।
২০২৬ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির পথে ভারত
বেলজিয়াম ও
নেদারল্যান্ডসে ২০২৬ সালের বিশ্বকাপের জন্য ভারত এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পুরুষ দল – ফিটনেস, ডিফেন্সিভ কনসিস্টেন্সি ও পেনাল্টি কর্নারে বৈচিত্র্য আনাই
হবে মূল লক্ষ্য।
নারী দল – রক্ষণভাগ শক্ত করা, মানসিক দৃঢ়তা ও ইউরোপীয় দলের সঙ্গে এক্সপোজার
ট্যুর হবে বড় প্রস্তুতি।
ভারতীয় হকির নতুন দিগন্ত
২০২৫ সালের
এশিয়া কাপ প্রমাণ করল ভারতীয় হকি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পুরুষদের সোনা ও নারীদের
রূপা মিলিয়ে ভারতীয় হকির ইতিহাসে এক বিরল অধ্যায় রচিত হয়েছে। এখন নজর ২০২৬ সালের
বিশ্বকাপের দিকে, যেখানে ভারতীয় পুরুষ ও নারী, দুটি দলই বিশ্বের সেরাদের চ্যালেঞ্জ
জানাতে প্রস্তুত।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন