Top News

আইসিসি মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৫-এর ফাইনালে আজ ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা: জেমিমার ব্যাটে সেমিফাইনাল জয়, এবার প্রথম বিশ্বজয়ের স্বপ্ন

 

পটভূমি: ব্যাঙ্গালুরুর ট্র্যাজেডি থেকে নাভি মুম্বাইয়ের আশা

২০২৫ সালের জুন মাসে ভারতীয় ক্রিকেটে ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ট্র্যাজেডি।
৪ জুন, আইপিএল ট্রফি জয় উদযাপনে রাস্তায় নামে কোটি সমর্থক। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু-র সেই বিজয় মিছিল পরিণত হয় ভয়াবহ দুর্ঘটনায়, যেখানে মারা যান ১১ জন, আহত হন ৫০ জনেরও বেশি। সরকারি তদন্তে প্রকাশ পায়, নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ঘাটতি ছিল। এর পরই বিসিসিআইআইসিসি যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে ব্যাঙ্গালুরুর এম. চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম আপাতত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য “নিরাপদ নয়”।

এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারত আয়োজিত আইসিসি মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৫। মূলত চিন্নাস্বামীতে নির্ধারিত ছিল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ, যার মধ্যে ছিল ভারতের দুই গ্রুপ ম্যাচ ও একটি সেমিফাইনাল। কিন্তু হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ম্যাচগুলি স্থানান্তরিত হয় নবি মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে। এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ভারতীয় মহিলা দলের প্রস্তুতিতে প্রথমে ধাক্কা আনলেও, পরে সেটাই হয়ে ওঠে নতুন আশ্রয়, নতুন দুর্গ।


ভেন্যু ও টুর্নামেন্ট কাঠামো

১৩তম আইসিসি মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৫ অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় যৌথভাবে। এইবারের টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে ৮টি দেশ —

  • ভারত (আয়োজক)
  • অস্ট্রেলিয়া
  • ইংল্যান্ড
  • নিউজিল্যান্ড
  • দক্ষিণ আফ্রিকা
  • বাংলাদেশ
  • শ্রীলঙ্কা (আয়োজক)
  • পাকিস্তান

স্থান:

  • গুয়াহাটি
  • ইন্দোর
  • বিশাখাপত্তনম
  • নবি মুম্বাই (ব্যাঙ্গালুরুর পরিবর্তে)
  • কলম্বো


ভারতের লিগ পর্বের যাত্রা

টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচেই ভারত শুরু করে দারুণভাবে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫৯ রানে জয়। পরবর্তী ম্যাচে ভারত হারায় পাকিস্তানকে ৮৮ রানে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে ভারত হারে ৩ উইকেটে। তারপরে ভারত ফের ৩ উইকেটে পরাজিত হয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। আবারও ইংল্যান্ডের কাছে ৪ রানে হারে ভারত। তবে সেই ধাক্কার পর ফের বঙ্গনারীরা জেগে ওঠে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ও ৫৩ রানে ম্যাচ জিতে ভারত শেষ চারে জায়গা পাকা করে। শেষ ম্যাচটি বাংলাদেশের সাথে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ায় ১টি করে পয়েন্ট সংগ্রহ করেছে দুই দেশ।

ভারতের লিগ রেকর্ড:

  • ম্যাচ: ৭
  • জয়: ৩
  • হার: ৩
  • ফলাফলহীন: ১
  • পয়েন্ট: ৭

দক্ষিণ আফ্রিকার লিগ পর্বের যাত্রা

ক্যাপ্টেন লরা উলফার্ট-এর নেতৃত্বে দলটি ব্যাট ও বল দুই বিভাগেই স্থিরতা দেখিয়েছে। গ্রুপ পর্বে তারা জিতেছে নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। মারিজান ক্যাপসুনে লুস-এর অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দলকে তুলেছে সেমিফাইনালে।

তাদের রেকর্ড:

  • ম্যাচ: ৭
  • জয়: ৫
  • হার: ২
  • পয়েন্ট: ১০


নকআউট পর্ব: অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে ভারত, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা

সেমিফাইনাল ১: ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া (নবি মুম্বাই)

এ ম্যাচেই জন্ম হলো নতুন নায়িকার — জেমিমা রডরিগেস। অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৩৩৮ তোলে। জেমিমার অপরাজিত ১২৭* (১৩৪ বল, ১৪ চার) রান এবং হরমনপ্রীত কৌরের ৮৮ বলে ৮৯ রান দলকে টেনে নিয়ে যায় জয়ের পথে।

ভারত বিজয়ী হয় ৫ ওইকেটে। এটি ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার মহিলা বিশ্বকাপের ফাইনালে ঘরের মাঠে প্রবেশ।

সেমিফাইনাল ২: দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ইংল্যান্ড (কলম্বো)

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা ১২৫ রানে জয়ী হয়। লরা উলফার্টের ১৬৯ রান (১৪৩ বল, ২০ চার, ৪ ছক্কা) দলের জয় নিশ্চিত করে।


জেমিমা রদ্রিগেস: “জিমখানা কাণ্ড” থেকে জাতীয় নায়িকা

একসময় নিজের বাবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য জিমখানায় ক্রিকেট অনুশীলনের সুযোগ হারিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছিলেন জেমিমা। আজ তিনি ভারতের সবচেয়ে স্থির ব্যাটসম্যান।

ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান (২০২৫ বিশ্বকাপ পর্যন্ত)

  • ম্যাচ: ৫৮
  • রান: ১৭২৫
  • গড়: ৩৫.২০
  • শতরান: ৩
  • অর্ধশতরান: ৮
  • স্ট্রাইক রেট: ৯০.৩১

তার ইনিংসগুলো ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। একসময় ভারতের মহিলা দলে মিডল অর্ডার ছিল অস্থির, কিন্তু জেমিমা সেটি পূরণ করেছেন নিখুঁতভাবে। তার কুল, স্থিরতা, শট নির্বাচন এবং মানসিক দৃঢ়তা ভারতীয় তরুণীদের জন্য এখন অনুপ্রেরণা।

মুখোমুখি পরিসংখ্যান ও রেকর্ড

সূচক

ভারত

দক্ষিণ আফ্রিকা

সেরা জয়ের শতাংশ (টুর্নামেন্ট)

৫০

৭৫

সর্বাধিক রান

স্মৃতি মান্ধানা (৩৮৯)

লরা উলফার্ট (৪৭০)

সর্বাধিক উইকেট

দীপ্তি শর্মা (১৭)

মারিজান ক্যাপ (১২)

সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর

রদ্রিগেস ১২৭* বনাম অস্ট্রেলিয়া

উলফার্ট ১৬৯ বনাম ইংল্যান্ড

সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর

৩৪১/৫ বনাম অস্ট্রেলিয়া

৩১৯/৭ বনাম ইংল্যান্ড

 

ফাইনাল প্রাকদর্শন: ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা — এক লড়াই, দুই স্বপ্ন

স্থান: ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়াম, নবি মুম্বাই
সময়: বিকেল ৩টা
আবহাওয়া: পরিষ্কার, তাপমাত্রা ৩১°C, আর্দ্রতা ৬৮%

ভারতের মূল শক্তি:

  • টপ অর্ডারে মান্ধানা ও শফালি ভার্মা
  • মিডল অর্ডারে জেমিমা রদ্রিগেস ও হারমানপ্রীত কৌর
  • বলিং আক্রমণে রেনুকা সিং ও দীপ্তি শর্মা

দক্ষিণ আফ্রিকার মূল অস্ত্র:

  • লরা উলফার্ট ও ট্রায়ন-এর ব্যাটিং
  • ক্যাপ ও লুসের গতিবেগ বোলিং
  • দলের ডিসিপ্লিন ও ফিল্ডিং

ম্যাচের গুরুত্ব: ভারত কখনও মহিলা বিশ্বকাপ জেতেনি। ২০০৫ ও ২০১৭ সালের মতো এবারও তারা ফাইনালে, তবে নিজেদের মাঠে এই প্রথমবার। দক্ষিণ আফ্রিকাও কখনও শিরোপা পায়নি। অর্থাৎ, ইতিহাস তৈরি হবে আজকে। যে দল জিতবে, সে-ই হবে নতুন চ্যাম্পিয়ন।


সম্প্রচার ও ডিজিটাল কভারেজ

মহিলা ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা এখন ভারতীয় ঘরে ঘরে। স্টার স্পোর্টস নেটওয়ার্কে আজকের ফাইনাল সম্প্রচার করবে হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, তামিল, তেলুগু ও কন্নড় ভাষায়।
প্রী-ম্যাচ শোতে থাকবেন মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী, আনজুম চোপড়া এবং অন্যরা।

ডিজিটাল দুনিয়ায় জিওহটস্টার সরাসরি স্ট্রিম করবে। ইন্টার‌্যাকটিভ স্ট্যাটস, লাইভ পোল, ও ফ্যান কমেন্টস, নতুন প্রজন্মের দর্শকদের জন্য এটি হয়ে উঠেছে অনন্য অভিজ্ঞতা।


ভারতের ভবিষ্যৎ: উজ্জ্বল আগামী

বিশ্বকাপ-পরবর্তী ভবিষ্যৎ আরও আশাজাগানিয়া। মহিলা প্রিমিয়ার লীগ (ডব্লিউ. পি. এল) এখন তৈরি করছে ট্যালেন্ট পাইপলাইন, যেখানে নতুন প্রজন্মের মেয়েরা আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রস্তুত করছে।

গ্রাসরুট লেভেলে বিসিসিআই-এর নতুন স্কিম ‘লক্ষ্য ২০৩০’ মেয়েদের ক্রিকেটে আরও অবকাঠামো গড়ে তুলছে। প্রথমবারের মতো রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনগুলোতে মহিলা কোচিং প্রোগ্রাম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

যদি আজ ভারত জেতে, সেটি শুধু ট্রফি নয়, এক প্রতীক হবে, যে মেয়েরা এখন আর “দ্বিতীয় সারির ক্রিকেটার” নয়, বরং ভারতীয় ক্রিকেটের গর্ব। আর কোনো ভেদাভেদ থাকবে না পুরুষ দলের সাথে।


নাভি মুম্বাইয়ে নতুন ইতিহাসের অপেক্ষা: প্রথমবার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছে দুই দেশ

ব্যাঙ্গালুরুর ট্র্যাজেডি হয়তো চিরকাল ভারতীয় ক্রিকেটের এক দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে,
কিন্তু নবি মুম্বাই আজ সেই ক্ষতকে পরিণত করতে চায় গৌরবে।

ফাইনালের এই দিনটা শুধু ক্রিকেটের নয়, এটি এক জাতীয় অনুভূতি। যেখানে মাঠে ২২ জন খেলোয়াড়, কিন্তু গ্যালারিতে, টিভির পর্দায়, মোবাইল স্ক্রিনে কোটি কোটি হৃদয় ধুকপুক করছে একসাথে।

হয়তো আজ সন্ধ্যায়, সূর্য যখন ডিওয়াই পাটিলের আকাশে ঢলে পড়বে,
ভারতের মেয়েরা তুলে ধরবে সেই ট্রফি — যা এক যুগের স্বপ্ন। আর যদি না-ও হয়, তারা ইতিমধ্যেই ইতিহাস গড়েছে — কারণ তারা প্রমাণ করেছে, “আমরা নারী, আমরাও পারি।”

আজকের ফাইনাল কেবল এক ম্যাচ নয়, এটি ভারতের মেয়েদের স্বপ্ন, আত্মসম্মান ও নতুন যুগের সূচনা। জয় হোক ক্রিকেটের, জয় হোক বঙ্গনারীর শক্তিতে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন