'দ্য গোট ট্যুর'ব্যানারে ছয়লাপ কলকাতার রাজপথ। মেসি আসছেন (Messi in Kolkata)। খবরটা কুসুম কুসুম শীতের সকালের মতোই শিহরণের আঁচ ঘনিয়ে তুলেছিল। ফুটবলের নক্ষত্রকে তিলোত্তমার ময়দানে আনার কাণ্ডারি ছিলেন যিনি, তাঁর নাম শতদ্রু দত্ত (Satadru Dutta)। এর আগে মারাদোনা সহ অনেক তারকাকে দেশে এনেছেন।
সেদিক দিয়ে উটকো কেউ নন। কিন্তু আগের প্রতিবার তিনি ছিলেন পর্দার আড়ালে। মেসির গোট ট্যুরকে (Messi GOAT tour) কেন্দ্র করে তাঁর ইমেজ একধাক্কায় প্রায় নায়কের স্তরে উঠে যায়!
কলকাতা, হায়দরাবাদ, দিল্লিতে কী হবে—এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই আপডেট দিচ্ছিলেন শতদ্রু। ফলে জন-উন্মাদনাও ধাপে ধাপে বাড়ছিল। আজ যুবভারতীতে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার পর একধাক্কায় নায়ক থেকে খলনায়ক এই বাঙালি আয়োজক!
এই বদলের কেন্দ্রে যিনি, তাঁকে বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হবে পথচলার দিকে। শতদ্রু দত্ত (Satadru Dutta) কোনও হঠাৎ উঠে আসা নাম নন। পেশায় তিনি একজন স্পোর্টস প্রোমোটার ও ইভেন্ট উদ্যোক্তা। সংস্থা 'আ শতদ্রু দত্ত ইনিশিয়েটিভ' (A Satadru Dutta Initiative)। ব্যাঙ্কিং ও ফিনান্স ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে এসে ২০১১ নাগাদ তিনি পুরোপুরি স্পোর্টস ইভেন্টে মন দেন। লক্ষ্য একটাই—ভারতে ফুটবলকে গ্লোবাল স্টেজের সঙ্গে যুক্ত করা।
এই টার্গেট নিয়ে একের পর এক 'লেজেন্ড ট্যুর'। ১৯৯৪ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলকে ভারতে আনা, পেলে (Pelé), দিয়েগো মারাদোনা (Diego Maradona), রোনাল্ডিনহো (Ronaldinho)—এঁদের সফরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে শতদ্রুর নাম। কলকাতার ফুটবলপ্রেমী মহলে তিনি ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে ওঠেন 'তারকা আনার মানুষ' হিসেবে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয়—এই সব সফরে শতদ্রু ছিলেন ব্যাকএন্ড অপারেটর। আলো ছিল তারকাদের উপর, আয়োজকের উপর নয়।
মেসির 'গোট ইন্ডিয়া ট্যুর ২০২৫'(GOAT India Tour 2025) সেই ছবিটাই পাল্টে দিয়েছে। চার শহর—কলকাতা, হায়দরাবাদ, মুম্বই, দিল্লি। প্রচার, সোশ্যাল মিডিয়া আপডেট, সম্ভাব্য অতিথির নাম—সবকিছুর কেন্দ্রে শতদ্রু নিজেই। পরিকল্পনা বড়। মেসিকে ঘিরে প্রদর্শনী ম্যাচ, তারকা-সাক্ষাৎ, রাজনীতি-বিনোদন-কর্পোরেট দুনিয়ার মেলবন্ধন। লক্ষ্য—ভারতে ফুটবলের 'ব্র্যান্ড ভ্যালু' বাড়ানো।
কিন্তু বাস্তবের মাটি রুক্ষ, নির্মম। কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে (Vivekananda Yuba Bharati Krirangan) যা ঘটল, তা গোটা সফরের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। দর্শক ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, প্রবেশ-প্রস্থান—সব মিলিয়ে একাধিক স্তরে ব্যর্থতা সামনে এসেছে। টিকিট কেটে দর্শকদের প্রায় কেউই মেসিকে ঠিকভাবে দেখতেই পেলেন না। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল মাঠে। চেয়ার, বোতল ছোড়া, পোস্টার ছেঁড়া—এই বিশৃঙ্খলার দায় কার? স্বাভাবিকভাবেই আয়োজকদের!
এখানেই শতদ্রুর ইমেজে এক ঝটকায় ধস। যিনি এতদিন 'স্বপ্ন দেখানো মানুষ', তিনিই হঠাৎ 'পরিকল্পনাহীনতার প্রতীক'। প্রশ্ন উঠতে শুরু করল—এত বড় ইভেন্টের জন্য কি যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল? ভিড়ের বাস্তব হিসেব, নিরাপত্তার স্কেল, স্টেডিয়ামের সীমাবদ্ধতা—সবটাই কি খাতায় ছিল, মাঠে নয়?
তবে ছবির অন্য দিকও আছে। এমন ভিড়, এমন উন্মাদনা—ভারতে ফুটবলের ক্ষেত্রে বিরল। সেটাও এক অর্থে শতদ্রুর কাজের ফল। মেসির নামেই যে এত মানুষ রাতভর লাইনে দাঁড়াবে, সেটাই প্রমাণ করে তিনি ভারতীয় ফুটবল দর্শকের আবেগ চিনতে পেরেছেন। কিন্তু আবেগ বুঝলেই হয় না, তা সামলানোর কাঠামোও চাই।
শতদ্রু দত্তের ভাবনায় শুধু তারকা আনা নয়, 'গ্রাসরুট ডেভেলপমেন্ট'-এর কথাও আছে। 'প্রোজেক্ট মহাদেব'-এর (Project Mahadeva) মতো উদ্যোগে তরুণ ফুটবলারদের ট্রেনিং ও স্কলারশিপের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে সেই ভবিষ্যৎমুখী ভাবনার চেয়ে আলোচনার কেন্দ্রে যুবভারতীর বিশৃঙ্খলা।
এই ট্যুর শেষ হবে। মুম্বই, দিল্লি পার হয়ে মেসি ফিরবেন। কিন্তু শতদ্রু দত্তের জন্য এই অধ্যায়টা রয়ে যাবে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে। এখান থেকে তিনি আবার 'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা'হয়ে উঠবেন, নাকি 'দুঃস্বপ্নের কাণ্ডারি' তকমা গায়ে লেগে থাকবে—তা নির্ভর করবে এই ধাক্কা থেকে কী শেখেন, তার উপর।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন