Top News

মঞ্চমায়া রেখে চলে গেলেন রতন থিয়াম

রতন থিয়াম আর আমাদের মাঝে নেই (১৯৪৮-২০২৫)। নিঃশব্দে বিদায় নিলেন ভারতীয় থিয়েটারের এক বর্ণময় অথচ গভীরতম স্তরের সাধক। এই মৃত্যু শুধু একজন নাট্যকার, নির্দেশক বা অভিনেতার প্রস্থান নয়। এ এক জ্ঞানতাপসের অন্তর্ধান, যিনি মঞ্চকে করেছেন দর্শনের ক্ষেত্র, কণ্ঠকে করেছেন চেতনার ভাষ্য।

মণিপুরের সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা রতন থিয়াম জাতিসত্তা, আত্মচেতনা ও মানবিক সংকটের এক অনুসন্ধিৎসু পর্যবেক্ষক। তাঁর নাট্যজগৎ কখনও ছিল না শুধু বিনোদনের বাহন, তা ছিল গভীর দার্শনিক অনুসন্ধানের এক অন্তর্মুখী অভিযাত্রা। সংস্কৃত নাট্যচেতনা, মণিপুরী নৃত্য, মার্শাল আর্টস, লোকধর্ম ও শাস্ত্রীয় সংগীতের উপাদানকে তিনি এক নব রূপে রূপান্তরিত করেন, যা ছিল সমকালীন অথচ চিরকালীন।

রতন থিয়ামের নাটকে ভাষা কেবল সংলাপ নয়, তা ছিল এক অন্তর্গত সংগীত, এক নিরবধি ধ্বনি, যা দর্শকের গভীরে প্রবেশ করে। তাঁর লেখনীতে প্রগাঢ় নীরবতা, ছন্দ, প্রতীক ও চিত্রময়তার সম্মিলনে গঠিত এক বহুমাত্রিক নাট্যভাষা। সেই ভাষায় ছিল সংকেত, প্রতীক্ষা, এবং অনেকটা বৌদ্ধ ধ্যানের মতো এক অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি ও বেদনার প্রকাশ।

রতন থিয়ামের নাটকে ভাষা শুধুমাত্র মুখের সংলাপ নয়, অভিনেতার দেহভঙ্গি, মঞ্চের গঠন, আলো-আঁধারি, সঙ্গীত, এবং নীরবতা এসবই ভাষা হয়ে ওঠে। অনেক সময়ই মুখের শব্দগুলো অল্প, ধ্বনির মতো উচ্চারিত হয়, কিন্তু শরীর ও পরিবেশ মিলে যে অনুভূতি সৃষ্টি করে তা সার্বজনীন।

এই প্রক্রিয়ায় তিনি ভাষার সীমানা অতিক্রম করেছেন। একজন বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজি না-জানা দর্শকও বুঝতে পারে সেই নাটকের আবেগ, সংকট, ব্যথা, বা অস্তিত্বের প্রশ্ন।

তিনি বিশ্বাস করতেন Theatre should speak to the eyes and the soul, not just the ears.

এই কারণে তাঁর মঞ্চজুড়ে থাকত প্রতীক, আঙ্গিক, রং, ছায়া, লোকশিল্পের রেফারেন্স যা ভাষার সীমা ছাড়িয়ে দর্শকের হৃদয়ে ছুঁয়ে যেত। ভাষা কোন বেরিয়ার নয় এখানে। ফলে তাঁর নাটকে ধ্বংসস্তূপ বা পবিত্র বৃক্ষ, বা চক্রাকৃতি নৃত্য সবই ছিল ভাষাহীন অথচ গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

তিনি নীরবতাকে ব্যবহার করেছেন ভাষার চেয়েও শক্তিশালী উপাদান হিসেবে।

রতন থিয়াম শুধুই নির্দেশক ছিলেন না; ছিলেন এক প্রতিষ্ঠান, এক মহাকাল। থিয়েটার নিয়েই তাঁর এন্টি এস্টাব্লিস্টমেন্ট মুভমেন্ট থিওরিটা লক্ষ্য করা যায়। যা সুবিমল মিশ্র তার লেখায় লিখেছিলেন। 

তিনি সঙ্গীত নাটক একাদেমি ও পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত, কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল তাঁর নাটক দেখে উঠে আসা দর্শকের নীরব চোখদুটি- যা বুঝে নিয়েছে শব্দের অতল ভাষা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন