ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা (Indian parallel cinema) যাকে আমরা অনেকেই Indian new wave cinema, Alternative cinema, Art house cinema, Middle cinema, Offbeat cinema, Realist cinema, অথবা Serious cinema বলে জানি। এটিও একটি প্রভাবশালী চলচ্চিত্র আন্দোলন যা Italian neorealism থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে 1940 এর দশকের গোড়ার দিকে ভারতে শুরু হয়। আন্দোলনটির প্রাথমিক পর্যায়ে নেতৃত্বে ছিল বাংলা সিনেমা কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এটি ভারতের অন্যান্য চলচ্চিত্র শিল্পেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিনেমাগুলো সত্য-ভিত্তিক এবং শিল্পভাবনায় ভরা সমাজসচেতন গল্প বলে, যা বাণিজ্যিক বিনোদনের পরিবর্তে বাস্তবতাকে তুলে ধরে। এই ধরনের চলচ্চিত্র গুলোতে সাধারণত দারিদ্র্য, বৈষম্য, সামাজিক অন্যায় এবং চলমান রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর কথা বলা হয়। চলচ্চিত্রগুলিতে গম্ভীর ও চিন্তাশীল বিষয়বস্তু, স্বাভাবিক, সহজ, বাস্তবধর্মী অভিনয় এবং বড়ো বড়ো অভিনেতাদের ব্যবহার না করে প্রায়শই অপেশাদার (non-professional) অভিনেতাদের ব্যবহার করা হয়। অতিনাটকীয়তা (overacting বা melodrama) এড়ানো হয়। বড়ো বড়ো সেট, দামী পোশাক ব্যবহার না করে সাধারণত সীমিত অর্থে বাস্তব লোকেশনে চিত্রায়িত করা হয়। ছবিগুলোতে সাধারণত গান বা নাচের ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে যদিও বা হয়ে থাকে তাহলে সেটা খুবই কম এবং গল্পের সাথে সম্পর্কিত থাকে। বক্স অফিস সফলতার উপর জোর না দিয়ে শিল্পগত প্রকাশের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছবিগুলোতে চলচ্চিত্রে পরিচালকের ব্যক্তিগত মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। এই ধরণের বেশিরভাগ চলচ্চিত্র সাধারণত সরকারী সহায়তায় তৈরি হয়। Film Finance Corporation (FFC) নাহলে NFDC (National Film Development Corporation) দ্বারা আর্থিক সাহায্য করা হয়।
1947 সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ভারত দারিদ্রতা, বর্ণ বৈষম্যের সমস্যা, বেকারত্ব, গ্রামের মানুষের দুর্দশা এবং দেশভাগের মানসিক আঘাতের মতো বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়। এই সময়ের চলচ্চিত্র পরিচালকরা চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের গল্প তুলে ধরতে। তারা চেয়েছিল তথাকথিত গল্প বলার ধরণ অবলম্বন না করে নতুন ধরণের গল্প বলতে। তার ফলে 1940 দশকের শেষের দিকে এবং 1950 দশকে শুরুর দিকে এই চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু হয়।
যদিও 1920 - 1930 এর দশকে হাতেগোনা কয়েকটি parallel cinema তৈরি হয়েছিল। যা সমাজের সাধারণ, নিম্নশ্রেণীর মানুষের গল্প তুলে ধরেছিল। এর অন্যতম পুরাতন উদাহরণ হলো — Baburao Painter পরিচালিত 1925 সালের নির্বাক চলচ্চিত্র ‘Savkari Pash’, যেখানে গ্রামীণ শোষণ ও কৃষকদের দুঃস্থ অবস্থার কথা বলা হয়েছিল এবং V. Shantaram পরিচালিত 1937 সালের ‘Duniya Na Mane’, যেখানে নারী অধিকারের পক্ষে একটি প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছিল।
এর পর 1940 দশকের শেষের দিকে কয়েকজন চলচ্চিত্র পরিচালক এই ধরণের সিনেমা বানানোর প্রতি গুরুত্ব দেয়। যেমন, Khwaja Ahmad Abbas এর পরিচালিত 1946 সালের ‘Dharti Ke Lal’ এবং একই বছর Chetan Anand পরিচালিত এবং Khwaja Ahmad Abbas রচিত ‘Neecha Nagar’ তৈরি হয় যা প্রথম বারের মতো ভারতীয় চলচ্চিত্র কে গোটা পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসে। এই চলচ্চিত্রটি প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র যেটি কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার Palme d'Or লাভ করে।
এই আন্দোলন 1950 দশকের শুরুর দিক থেকে শুরু করে 1960 এর দশকে জোরালো ভাবে আকার নিতে শুরু করে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখকের হাত ধরে। বাণিজ্যিক সিনেমার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে, তথাকথিত গল্প বলার ধরণের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে এই আন্দোলন শুরু হয়। কারণ, বলিউড ছিল রোম্যান্স, অ্যাকশন, কমেডি, খলনায়ক, গান-নাচের দৃশ্য ও কল্পনার মতো ছাঁদবদ্ধ গল্পে পরিপূর্ণ। Parallel cinema গড়ে ওঠে কারণ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতা সিনেমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ভারতীয় সমাজের বাস্তব সত্য তুলে ধরার জন্য। তারা গান-নাচভিত্তিক কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। এই ধারাটি বিশ্ব সিনেমা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল এবং সরকারি সহায়তাও পেয়েছিল। এই সময়কালকে ভারতীয় সিনেমার ‘Golden Age’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়ের সিনেমাগুলো সাধারণত ভারতীয় সাহিত্য থেকে প্রভাবিত হয়েছিলো। শুরুর দিক থেকেই ভারতীয় সিনেমায় এমন চলচ্চিত্র নির্মাতারা ছিলেন, যারা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, বরং আরও বৃহত্তর উদ্দেশ্যে সিনেমা বানিয়ে গেছেন। তাঁরা সমসাময়িক সমস্যাগুলিকে তুলে ধরেছেন এবং অনেক সময় নতুন নতুন বিষয়ও জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। এই সময়ের বেশ কিছু চলচ্চিত্র পরিচালক এবং তাদের সৃষ্টি চলচ্চিত্র যেমন - Satyajit Ray এর Pather Panchali (1955), Aparajito (1956), Devi (1960), Abhijan (1962), Mahapurush (1965). Ritwik Ghatak এর Meghe Dhaka Tara (1960), Komal Gandhar (1961), Subarnarekha (1965). Bimal Roy এর Do Bigha Zamin (1953), Bandini (1963), Sujata (1959), Parakh (1960). Mrinal Sen এর Bhuvan Shome (1969), Baishey Shravan (1960). Tapan Sinha র Atithi (1965), Apanjan (1968) এবং V. Shantaram এর Duniya Na Mane (1937), Padosi (1941), Do Aankhen Barah Haath (1957), Dr. Kotnis Ki Amar Kahani (1946). যদিও তিনি Parallel Cinema বানাননি, কিন্তু তাঁর কাজ Parallel Cinema-র আদর্শ ও ভাষার আগাম ইঙ্গিত দেয়। তিনি ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পরিচালক যিনি বিনোদনের বাইরেও সিনেমাকে সমাজের জন্য ব্যবহার করেছিলেন।
1970 এর দশক শুরু হতে ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে শুরু হয় এক নতুন দৌড় যা 1980 দশক পর্যন্ত অনবরত চলতে থাকে। এই সময়কে Indian parallel cinema র স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময়ের চলচ্চিত্র পরিচালকরা একের পর এক যুগান্তকারী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা আজও নতুন পরিচালকদের এই ধরণের সিনেমা বানাতে উৎসাহ দেয়। তৎকালীন সিনেমাগুলো হিন্দি মূল ধারার সিনেমা না হলেও বাণিজ্যিক ভাবে সফল হতে শুরু করে। দর্শকদের এই ধরণের সিনেমার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। এই চলচ্চিত্রগুলি বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মান পেতে শুরু করে। এই সময়ের বেশ কিছু চলচ্চিত্র পরিচালক এবং তাদের চলচ্চিত্র যেমন - Shyam Benegal এর Ankur (1974), Nishant (1975), Manthan (1976), Bhumika (1977), Mandi (1983), Trikal (1985), Kalyug (1981). Govind Nihalani র Aakrosh (1980), Ardh Satya (1983), Party (1984), Droh Kaal (1994). Saeed Akhtar Mirza র Salim Langde Pe Mat Ro (1989), Arvind Desai Ki Ajeeb Dastaan (1978), Albert Pinto Ko Gussa Kyoon Aata Hai? (1980), Mohan Joshi Hazir Ho! (1984), Naseem (1995). Mani Kaul এর Uski Roti (1969), Duvidha (1973), Nazar (1991), Ashadh Ka Ek Din (1971). Adoor Gopalakrishnan র Elippathayam (1982), Mathilukal (1990), Anantaram (1987), Swayamvaram (1972). Kumar Sahani র Tarang (1994), The Township (1991) এবং Maya Darpan (1972) যা ভারতীয় parallel cinema র একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র হিসাবে গন্য করা হয়।
এই সময়ে হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি বেশ কিছু পরিচালক আঞ্চলিক ভাষায় parallel সিনেমা তৈরী করেন। যেমন - Chidambaram (1985), Amma Ariyan (1986), Samna (1974), Halodhia Choraye Baodhan Khai (1984).
এর পর আসে 1990 এর দশক। এই দশকের শুরুর দিকেও বেশ কিছু parallel cinema তৈরি হলেও ধীরে ধীরে তা হ্রাস পেতে থাকে। দর্শকদের আগ্রহ, অর্থনৈতিক শঙ্কট, বাণিজ্যিক বলিউড সিনেমার উত্থান, সীমিত পরিবেশন, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন, সরকারি সহায়তার অভাব বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে parallel cinema র সংখ্যা কমতে থাকে। যদিও বাণিজ্যিক বলিউড সিনেমার উত্থান Amitabh Bachchan এর হাত ধরে 1970 এর দশকেই শুরু হয়ে গেছিল কিন্তু সেই সময় দর্শক বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি আর্ট ফিল্ম দেখাও পছন্দ করত। Zanjeer (1973), Deewaar (1975), Sholay (1975) র মতো সিনেমা যেখানে সমাজে চলমান অন্যায়, দুর্নীতি, বেকারত্ব ইত্যাদির প্রতিবাদ সিনেমায় প্রতিফলিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দর্শক Amar Akbar Anthony (1977), Coolie (1983) র মতো বাণিজ্যিক সিনেমার প্রতি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে যার ফলে আর্ট ফিল্ম ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং বাণিজ্যিক ফিল্ম সফল ভাবে ব্যবসা করতে থাকে।
1990 দশকে parallel cinema হ্রাস পেলেও তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনও পর্যন্ত যেই সমস্ত সিনেমা তৈরি হয়ে চলেছে তাকে আমরা Late parallel cinema বা Modern parallel cinema বা Independent cinema বলে জানি। বেশ কিছু পরিচালক এখনও পর্যন্ত এই ধরণের সিনেমা বানিয়ে চলেছেন। বহু নতুন নতুন পরিচালক আগের সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আজও সেই ধারার সিনেমা বানিয়ে চলেছেন। যদিও সময়ের সাথে সাথে কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে। 1990 দশকের গোড়ার দিকের কিছু চলচ্চিত্র যেমন - Rituparno Ghosh এর Unishe April (1994), Aparna Sen এর Mr. & Mrs. Iyer (2002), Shyam Benegal এর Mammo (1994), Samar (1999), Hari - Bhari (2000).
2000 এর পর থেকে বহু স্বাধীন পরিচালক এই ধরণের সিনেমা বানিয়ে চলেছেন। এখনকার সিনেমাগুলোকে আমার পুরোপুরি ভাবে parallel cinema বলতে পারি না কিন্তু সেগুলো parallel cinema র ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। বর্তমান সময়ের বেশ কিছু পরিচালক এবং তাদের চলচ্চিত্র যেমন - Gurvinder Singh এর Anhe Ghore Da Daan (2011). Chaitanya Tamhane র Court (2014). Raam Reddy র Thithi (2015). Neeraj Ghaywan er Masaan (2015) Avinash Arun এর Killa (2014) Prateek Vats এর Eeb Allay Ooo! (2019)
ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা কেবলমাত্র একটি চলচ্চিত্র ধারা নয়, এটি ছিল এক ধরনের প্রতিবাদ, এক রূপান্তর, যা সিনেমাকে কল্পনার জগৎ থেকে টেনে বাস্তবতার মাটিতে দাঁড় করায়। যেখানে পরিচালকরা বিনোদনের বাইরেও সিনেমাকে সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করেছেন। যদিও আজকের দিনে এই ধারার প্রভাব কিছুটা ম্লান, তবুও নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের হাতে আবারও তা নতুনভাবে প্রাণ পাচ্ছে। সমান্তরাল সিনেমা আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়— সিনেমা কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি পরিবর্তনের হাতিয়ারও হতে পারে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন