ভারতের পাঁচ টেস্টের ইংল্যান্ড সফর নিঃসন্দেহে এক মহাকাব্যিক কাহিনি ছিল; উত্তেজনাপূর্ণ এক দ্বন্দ্ব, যা ২-২ ড্র-এ সমাপ্তি পায়। নতুন অধিনায়ক শুভমান গিলের নেতৃত্বে ভারত পাঁচটি ঐতিহাসিক স্থানে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে অংশ নেয়, আর সেইসাথে ভাগাভাগি করে নেয় নতুনভাবে চালু হওয়া অ্যান্ডারসন-তেন্ডূলকর ট্রফি। টেস্ট সিরিজের পর, ভারত এখন তাকিয়ে আছে আরবে আয়োজিত এশিয়া কাপ ২০২৫-এ শিরোপা রক্ষার দিকে (৯–২৮ সেপ্টেম্বর), যেখানে দলের প্রধান কোচ গৌতম গম্ভীর দিচ্ছেন কৌশলগত নেতৃত্ব।
১ম টেস্ট – হেডিংলি, লিডস
সারসংক্ষেপ:
হেডিংলিতে শুভমান গিল তার টেস্ট অধিনায়কত্বের অভিষেকে খেলেন এক দুর্দান্ত ১২৭ রানের ইনিংস, যা ভারতের প্রথম দিনের লড়াইকে দারুণভাবে এগিয়ে দেয়। তবে অন্যান্যদের কাছ থেকে সমর্থন না পাওয়ায় ভারত ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে ইংল্যান্ডের শৃঙ্খলাবদ্ধ বোলিং আক্রমণে। শেষ পর্যন্ত আয়োজনকারীরা জয় ছিনিয়ে নেয় সামান্য ব্যবধানে।
বিশ্লেষণ:
অধিনায়কত্বের অভিষেকে শতক হাঁকানো গিল ভারতীয় ইতিহাসে পঞ্চম অধিনায়ক যিনি হাজারে আর কোহলির মতো কিংবদন্তিদের পাশে নাম লেখালেন। কেএল রাহুল ও রবীন্দ্র জাডেজার কিছু অবদান সত্ত্বেও, জশ টাঙ্গের নেতৃত্বাধীন ইংলিশ বোলিং আক্রমণ ম্যাচ নির্ধারণ করে দেয়।
মূল শিক্ষা: দারুণ সূচনা হলেও স্পষ্ট হয়ে গেল ভারতের আরও গভীরতা ও দৃঢ়তার প্রয়োজন।
২য় টেস্ট – এজবাস্টন, বার্মিংহাম
সারসংক্ষেপ:
গিলের আরেকটি অনবদ্য সেঞ্চুরি (অপরাজিত ১১৪*) ভারতের প্রথম ইনিংসে শক্ত অবস্থান তৈরি করে। শেষ পর্যন্ত ভারত ম্যাচ জিতে সিরিজে সমতা ফেরায়।
বিশ্লেষণ:
টানা দুটি সেঞ্চুরি গিলকে ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে এক অনন্য পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছে। রাহুল ও জাডেজা তাকে সহায়তা করেছেন, আর বোলাররা সঠিক সময়ে উইকেট এনে দিয়েছেন।
সিরিজ অবস্থা: ভারত ১–১ সমতায় ফিরল।
৩য় টেস্ট – লর্ডস, লন্ডন
সারসংক্ষেপ:
স্নায়ুর এক লড়াইয়ে ভারতের জয়ের স্বপ্ন ভেস্তে যায়, তবে ওয়াশিংটন সুন্দর চার উইকেট নিয়ে দলকে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে রাখেন। ইংল্যান্ড অল্প ব্যবধানে এগিয়ে যায়।
বিশ্লেষণ:
“হোম অফ ক্রিকেট”-এ ভারতের লড়াই প্রশংসনীয় ছিল। ম্যাচ জিততে না পারলেও সুন্দরর অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দলের লড়াকু মানসিকতার প্রতীক হয়ে উঠল।
৪র্থ টেস্ট – ওল্ড ট্রাফোর্ড, ম্যানচেস্টার
সারসংক্ষেপ:
অত্যন্ত নাটকীয় ম্যাচে ভারত অসম্ভব অবস্থান থেকে লড়ে ফেরে। গিলের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইনিংসে রোমাঞ্চকর চেজ হলেও ম্যাচটি ড্র হয়।
বিশ্লেষণ:
এই ম্যাচ প্রমাণ করল ভারতের গভীরতা ও চরিত্র। গিল, জাডেজা ও রাহুল আবারো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন। ইংল্যান্ডও নিজেদের মাটিতে ধারাবাহিক শক্তি দেখাল, আর চূড়ান্ত টেস্টের জন্য রইল রোমাঞ্চ।
৫ম টেস্ট – দ্য ওভাল, লন্ডন
সারসংক্ষেপ:
এক ঐতিহাসিক সমাপ্তি! শেষ দিনে ভারত ৬ রানের জয়ে সিরিজ ২-২ সমতায় শেষ করে। নায়ক ছিলেন মোহাম্মদ সিরাজ, যিনি নিলেন পাঁচ উইকেট।
বিশ্লেষণ:
৩৭৪ রান ডিফেন্ড করতে নেমে ভারত চাপে পড়লেও স্থির থেকেছে। রুট ও হ্যারি ব্রুকের সেঞ্চুরি সত্ত্বেও সিরাজের আবেগঘন বোলিং ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়। ইংল্যান্ডের নাটকীয় পতন, বিশেষ করে ক্রিস ওকসের একা ব্যাট করা, ম্যাচটিকে স্মরণীয় করে তুলল।
ফলাফল: ২-২ ড্র-এর সিরিজটি এখন আধুনিক যুগের এক ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সিরিজের পরিসংখ্যান ও হাইলাইটস
- সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক:
- ভারত: শুভমান গিল – ৭৫৪ রান (গড় ৭৫.৪)
- ইংল্যান্ড: জো রুট – ৫৩৭ রান
- সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক:
- ভারত: মোহাম্মদ সিরাজ – ২৩ উইকেট
- ইংল্যান্ড: জশ টাঙ্গ – ১৯ উইকেট
- অন্যরা: বেন স্টোকস, জসপ্রিত বুমরাহ শীর্ষ পাঁচে।
- সিরিজ সেরা খেলোয়াড়: হ্যারি ব্রুক (ইং) ও শুভমান গিল (ভারত)।
- শুভমান গিলকে জুলাই মাসের জন্য আইসিসি মাসের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
এই রেকর্ডগুলো এখন স্থায়ীভাবে খোদাই হয়ে গেল উদ্বোধনী অ্যান্ডারসন–তেন্ডুলকর ট্রফি ২০২৫-এর অধ্যায়ে।
ভবিষ্যৎ: গৌতম গম্ভীরের অধীনে ভারত ও এশিয়া কাপ ২০২৫
গম্ভীরের অধীনে ভারতের দৃষ্টি
গিল ও পান্তের মতো নতুন নেতাদের উত্থান, আর গম্ভীরের অভিজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের কৌশলকে বদলে দিতে পারে। অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, পেসারদের লালন-পালন আর টি২০ প্রতিভা তৈরি করাতেই এখন মূল জোর দেওয়া হচ্ছে, যাতে এশিয়া কাপে দলটি সেরা পারফরম্যান্স দিতে পারে।
এশিয়া কাপ ২০২৫ – আরব, ৯-২৮ সেপ্টেম্বর
এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল নিশ্চিত করেছে যে এবারের এশিয়া কাপ টি২০ ফরম্যাটে অনুষ্ঠিত হবে দুবাই ও আবুধাবিতে।
- ফরম্যাট ও দলসমূহ: ৮ দল দুই গ্রুপে বিভক্ত; ভারত, পাকিস্তান, ইউএই, ওমান গ্রুপ এ-তে।
- ভারত বনাম পাকিস্তান দ্বন্দ্ব: ১৪ সেপ্টেম্বর, দুবাইতে – যার অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব।
- ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন: ভারত ২০২৩ সালের শিরোপাজয়ী।
- দল নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ: গিল, জয়সওয়াল, স্যামসনের মতো খেলোয়াড়দের ঘিরে আলোচনা চলছে।
এশিয়া কাপ হবে ভারতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি মঞ্চ, যা আগামী টি২০ বিশ্বকাপের দিকে তাদের দৃষ্টি স্থির করবে।
এশিয়া কাপ ২০২৫ এর জন্য প্রস্তুত ভারতের দল
ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (BCCI) এশিয়া কাপ ২০২৫-এর জন্য এক শক্তিশালী ও সুষম ১৫ জনের দল ঘোষণা করেছে। নেতৃত্বে থাকছেন আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের জন্য পরিচিত সুর্যকুমার যাদব, আর সহ-অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছেন শুভমান গিল।
উইকেটকিপার হিসেবে স্যামসন এবং জিতেশ দলে রয়েছেন। অলরাউন্ডার বিভাগে হার্দিক পাণ্ডিয়া, অক্ষর প্যাটেল ও শিভম দুবে দলকে ভারসাম্য দেবে। ব্যাটিং লাইন-আপে রয়েছেন প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা – অভিষেক শর্মা, তিলক ভার্মা ও রিঙ্কু সিং, যারা সাম্প্রতিক সিরিজে চমৎকার পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন।
বোলিং বিভাগে অভিজ্ঞ জসপ্রিত বুমরাহ ও অর্শদীপ সিংহ গতি আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন, সাথে থাকছেন তরুণ প্রতিভা হর্ষিত রানা। স্পিন বিভাগে কুলদীপ যাদব ও বরুণ চক্রবর্তী আছেন, যারা মাঝের ওভারগুলোতে বৈচিত্র্য এবং নিয়ন্ত্রণ দেবে।
গৌতম গম্ভীরকে প্রধান কোচ করে, এই দল ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন যুগের প্রতিচ্ছবি যেখানে আক্রমণাত্মক মানসিকতার সাথে কৌশলগত গভীরতাও রয়েছে। লক্ষ্য একটাই, এশিয়া কাপের শিরোপা ধরে রাখা।
পূর্ণ স্কোয়াড:
- সুর্যকুমার যাদব (অধিনায়ক)
- শুভমান গিল (সহ-অধিনায়ক)
- অভিষেক শর্মা
- সানজু স্যামসন (উইকেটকিপার)
- তিলক ভার্মা
- হার্দিক পাণ্ডিয়া
- রিঙ্কু সিং
- জিতেশ শর্মা (উইকেটকিপার)
- অক্ষর প্যাটেল
- শিভম দুবে
- কুলদীপ যাদব
- বরুণ চক্রবর্তী
- হর্ষিত রানা
- জসপ্রিত বুমরাহ
- অর্শদীপ সিংহ
প্রধান কোচ: গৌতম গম্ভীর
ওভালে নাটকীয় জয়, ২০২৫ সালের গ্রীষ্মে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন সংজ্ঞা
ভারতের ২০২৫ সালের ইংল্যান্ড সফর এনে দিল নাটক, দৃঢ়তা, আর অবিস্মরণীয় ক্রিকেট। ২-২ ড্র, যেখানে অসাধারণ ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সগুলো ইতিহাসে জায়গা করে নিল, ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন অধ্যায় সূচনা করল শুভমান গিলের নেতৃত্বে। গৌতম গম্ভীরের কৌশলগত তত্ত্বাবধানে দল যখন এশিয়া কাপ শিরোপা রক্ষায় প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাই এই গ্রীষ্মকে বলা যায় ভারতীয় ক্রিকেটের এক সংজ্ঞায়িত মোড়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন