২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বর। রাত নামতেই মুম্বাইয়ের সেই চিরপরিচিত আলো-ঝলমলে পরিবেশ মুহূর্তে পাল্টে গেল এক বীভৎস রণক্ষেত্রে। আরব সাগর পেরিয়ে আসা ১০ জন সশস্ত্র জঙ্গি একসঙ্গে আঘাত হানল শহরের প্রাণকেন্দ্রে। এটি ছিল ভারতের ইতিহাসে এক নারকীয় আক্রমণ, যা চলেছিল প্রায় তিন দিন ধরে।
প্রথমেই জঙ্গিরা গুলি চালাল ব্যস্ত ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ টার্মিনাস (CSMT)-এর যাত্রীদের লক্ষ্য করে। পাকিস্তানি জঙ্গি আজমল কাসাব ও তার সঙ্গীর নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারালেন অন্তত ৫৮ জন নিরীহ মানুষ। প্রায় একই সময়ে, জনপ্রিয় লিওপোল্ড ক্যাফেতে রক্ত ঝরল, আর কয়েকটি ট্যাক্সিতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে শহরজুড়ে তৈরি হলো আরও আতঙ্ক। কিন্তু আসল লক্ষ্য ছিল শহরের প্রতীকগুলো—বিখ্যাত তাজমহল প্যালেস হোটেল, ওবেরয়-ট্রাইডেন্ট এবং ইহুদিদের কেন্দ্র নারিমান (চাবাদ) হাউস। এই তিনটি জায়গায় শুরু হলো ভয়াবহ জিম্মি সংকট।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে এলেন মুম্বাই পুলিশের সাহসী সদস্যরা। কিন্তু গভীর রাতে জঙ্গিদের অতর্কিত হামলায় দেশের জন্য জীবন দিলেন অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড (ATS)-এর প্রধান হেমন্ত কারকারে, এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞ বিজয় সালস্কার ও অশোক কামটে-সহ বেশ কয়েকজন অফিসার। তবে পুলিশের সাহসিকতায় ধরা পড়ল প্রধান হামলাকারীদের একজন, আজমল কাসাব। তার গ্রেফতারি ছিল এই হামলার একমাত্র জীবিত প্রমাণ।
কিন্তু লড়াই তখনও বাকি। শহরজুড়ে জিম্মি সংকট আর গুলির শব্দ। খবর পৌঁছালো দিল্লিতে। ২৭শে নভেম্বর সকালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (NSG) কমান্ডোরা মুম্বাইয়ে পৌঁছালেন। শুরু হলো "অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো"। দিনে দুপুরে পুরো দেশ দেখল, কীভাবে কমান্ডোরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধোঁয়া ও আগুনের মাঝে ঢুকে জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। ওবেরয় ট্রাইডেন্টের জিম্মি সংকট দ্রুত মিটলেও, নারিমান হাউস এবং বিশেষত তাজমহল হোটেলে লড়াই চলল টানা ৬০ ঘণ্টা।
অবশেষে, ২৯শে নভেম্বর সকালে তাজমহল হোটেলের শেষ জঙ্গিটিকে নিকেশ করার মাধ্যমে এই ভয়াবহ অবরোধের সমাপ্তি হলো। টানা চার দিনের এই হামলায় মুম্বাইয়ের ১৬৬টি তাজা প্রাণ ঝরে গেল এবং আহত হলেন আরও প্রায় ৩০০ জন। এই ঘটনা ভারতের ইতিহাসে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে গেল, যা ২৬/১১ নামে দেশের মানুষের মনে আজীবন সাহসিকতা ও শোকের প্রতীক হয়ে থাকবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন