মহাকাশ বিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায় - ১৪ ই এপ্রিল, জেফ বেজোসের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লু অরিজিন এক ঐতিহাসিক মাইলফলক ছুঁয়েছে। সংস্থাটির সাবঅরবিটাল মহাকাশযান NS-31-এ সফলভাবে যাত্রা করেছে একটি তারকাখচিত অল-উইমেন ক্রু। এই অভিযানে অংশ নেন ছয়জন খ্যাতিমান ও স্বনামধন্য নারী, যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে এসেছেন।
ক্রু সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বখ্যাত পপ তারকা ও সমাজসেবী কেটি পেরি, সিবিএস-এর অভিজ্ঞ সাংবাদিক গেইল কিং, প্রাক্তন নাসা রকেট বিজ্ঞানী আইশা বোয়ে, নাগরিক অধিকারকর্মী ও বায়োঅ্যাস্ট্রোনটিক্স গবেষক আমান্ডা নুয়েন, চলচ্চিত্র প্রযোজক কেরিয়ান ফ্লিন, এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে—সাংবাদিক, হেলিকপ্টার পাইলট এবং জেফ বেজোসের বাগদত্তা লরেন সানচেজ, যিনি পুরো মিশনের নেতৃত্ব ও সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন।
ডিসাইনার নীল ফ্লাইট স্যুট পরে মহাকাশযাত্রায় অংশ নেওয়া ছয় নারী ছিলেন দারুণ উচ্ছ্বসিত। ইতিহাসের অংশ হতে পেরে তাঁদের চোখেমুখে ছিল আবেগ ও আনন্দের ঝলক। মিশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, তারা মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন, হেসে উঠছেন, লাফাচ্ছেন এবং এমনকি গানও গাইছেন।
এই অসাধারণ যাত্রায় একটি বিশেষ মুহূর্ত সৃষ্টি করেন পপ তারকা কেটি পেরি, যিনি ফ্লাইট চলাকালীন তাঁর সহযাত্রীদের জন্য একটি আবেগঘন গান পরিবেশন করেন। মুহূর্তটি গোটা মিশনের আবেগ ও বন্ধুত্বের আবহে এক অনন্য মাত্রা যোগ করে। পুরো অভিযানটি ছিল একসঙ্গে মজা, বন্ধন এবং নারী-ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল উদযাপন।
মিশন শেষে ক্রু সদস্যরা জানান, তাঁরা আশা করেন এই যাত্রা এমন প্রতিটি কন্যার জন্য অনুপ্রেরণা হবে—যারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, কিন্তু সবসময় সেই স্বপ্নকে সাহস করে বেছে নেওয়ার প্রেরণা পায় না। তারা বলেন, এটি একটি সাহসী ও অত্যন্ত জরুরি বার্তা, কারণ আজও মহাকাশ গবেষণা ও স্টেম (STEM) খাতে নারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত।
সমাজের চাপ, প্রতিষ্ঠানের বাধা—এই সবকিছু মিলে অনেক মেয়েকে বিজ্ঞান ও মহাকাশের স্বপ্ন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এই মিশনের ক্রু সদস্যরা চান, তাঁদের এই অভিযান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেয়েদের জন্য একটি আলোকবর্তিকা হয়ে উঠুক, যা তাদের ‘আক্ষরিক অর্থেই’ মহাকাশ দখলের সাহস জোগাবে।
যেখানে আলো থাকে, সেখানেই থাকে ছায়া—এ কথা ফের প্রমাণিত হয়েছে ব্লু অরিজিনের ইতিহাস গড়া অল-উইমেন মহাকাশ মিশনের পর। একদিকে যেমন অনেকে এই মিশনকে নারীর ক্ষমতায়নের এক সাহসী পদক্ষেপ ও অনুপ্রেরণাদায়ক ঘটনা হিসেবে প্রশংসা করেছেন, অন্যদিকে তেমনি নানা সমালোচনাও উঠে এসেছে জনমনে।
সমালোচনার একটি বড় অংশের মূল বক্তব্য ছিল—এই মিশনে বাস্তব কোনো বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব নেই, বরং এটি ছিল সেলিব্রিটিদের একটি বিলাসবহুল 'ভ্রমণ' বা 'জয়রাইড'। যদিও এই যুক্তির পেছনে কিছু বাস্তব প্রশ্ন ও যুক্তিনির্ভর মতামতও ছিল, অনেক সমালোচনার মধ্যেই ছিল পুরনো কুসংস্কার ও নারী-বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির ছায়া।
তবে মনে রাখা জরুরি, ব্লু অরিজিন বা ইলন মাস্কের স্পেসএক্স-এর মতো বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলো শুরু থেকেই মহাকাশ পর্যটনের ধারণা এবং মহাকাশকে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। সাবঅরবিটাল এই মহাকাশযানগুলো মূলত তৈরি করা হয়েছে প্রশিক্ষিত সরকারি মহাকাশচারীদের বাইরেও মহাকাশকে সবার জন্য উন্মুক্ত করার প্রয়াসে।
এই প্রেক্ষাপটে মিশনটিকে শুধুমাত্র “আনন্দভ্রমণ” বলে খাটো করে দেখা হলে তা মহাকাশযাত্রার ভবিষ্যৎ বেসরকারিকরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হবে। নারী নেতৃত্বাধীন এই অভিযানে যেমন ছিল প্রতীকী গুরুত্ব, তেমনি এটি ছিল স্পেস এক্সপ্লোরেশনের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
ব্লু অরিজিনের অল-উইমেন মহাকাশ মিশন প্রশংসার পাশাপাশি তীব্র সমালোচনাও ডেকে এনেছে, বিশেষত ক্রু নির্বাচনের প্রক্রিয়া ঘিরে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এই অভিযানে কেবল ধনী ও পরিচিত নারীদেরই সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের প্রকৃতপক্ষে ‘মহাকাশে থাকার কথা ছিল না’। তবে এই অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়।
আইশা বোয়ে, যিনি একজন প্রাক্তন নাসা রকেট বিজ্ঞানী, এবং আমান্ডা নুয়েন, একজন বায়োঅ্যাস্ট্রোনটিক্স গবেষক ও নাগরিক অধিকারকর্মী—এই দুই সদস্য মহাকাশ ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাঁদের অন্তর্ভুক্তি প্রমাণ করে যে এই মিশনের ভিতরেই রয়েছে বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক গুরুত্ব।
এটা সত্য যে মিশনের প্রতিটি সদস্য বিজ্ঞানী নন। তবে এই মিশনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছিল না। বরং এর লক্ষ্য ছিল একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া: মহাকাশ আর কেবল পুরুষদের বা বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্র নয়—এটি সবার জন্য।
১৯৬৩ সালে ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভার একক মহাকাশযাত্রার পর এই প্রথম কোনো অল-উইমেন ক্রু মহাকাশের প্রান্তে পা রাখল। এটি নারী-পুরুষ সমতার দীর্ঘ সংগ্রামে এক স্মরণীয় মুহূর্ত।
ব্লু অরিজিনের অল-উইমেন স্পেস মিশন নিয়ে চলমান বিতর্কের জবাব দিয়েছেন মিশনের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য গেইল কিং ও আইশা বোয়ে।
সিবিএস-এর প্রবীণ সাংবাদিক গেইল কিং মিশনের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, “প্রতিনিধিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু যাত্রাটাকে দেখবেন না, এর গভীরতাকে বুঝুন। এটা একটা বার্তা—সবাই যেন নিজেকে এই জগতে ভাবতে পারে।” তাঁর কথায় স্পষ্ট, এই মিশন কেবল একটি ফ্লাইট নয়, বরং এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন।
এদিকে, মিশনে ব্যবহৃত নিউ ইয়র্কের ফ্যাশন লেবেল Monse-এর তৈরি নীল ফ্লাইট স্যুট নিয়েও উঠেছে সমালোচনা—অনেকে একে ‘অতিরিক্ত গ্ল্যামারাইজড’ বলে কটাক্ষ করেছেন। এর জবাবে প্রাক্তন নাসা বিজ্ঞানী আইশা বোয়ে বলেন, “এটা শুধু ফ্যাশনের বিষয় নয়। এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ—এখানে রয়েছে স্টাইল, কাঠামো এবং কার্যকারিতা। এটি একসঙ্গে ফ্যাশন, ফর্ম এবং ফাংশন।”
এটি অস্বীকার করা যাবে না যে এমন একটি মহাকাশযাত্রায় অংশ নেওয়ার সুযোগ এখনো কেবল ধনী ও প্রভাবশালী মানুষের জন্যই উন্মুক্ত। এই দিকটি যেমন সত্য, তেমনি এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখার একটি দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে।
যেসব ভিডিও ও সাক্ষাৎকার সামনে এসেছে, তাতে স্পষ্ট—এই নারীরা কেবল এক বিশেষ সুযোগই পাননি, তাঁরা ছিলেন গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত। তাদের চোখেমুখে ছিল শিশুসুলভ উত্তেজনা, গর্ব এবং বিস্ময়। হয়তো পৃথিবীর কোনো প্রান্তে বসে থাকা একজন কিশোরী এই দৃশ্য দেখে ভাবতে পারে, “আমি একদিন ওখানে থাকতে পারি।”
সবাই হয়তো এখনই যেতে পারবে না, কিন্তু হয়তো এই সুনির্বাচিত দলটিকে পাঠানোর মধ্যেই একটি কৌশলগত বার্তা ছিল। একজন পপ তারকা, সাংবাদিক বা অধিকারকর্মীকে মহাকাশে দেখে হয়তো কেউ নিজের স্বপ্নকে আর অসম্ভব মনে করবে না। পরিচিত মুখগুলোর অভিজ্ঞতা হয়তো অচেনা স্বপ্নকে আরও বাস্তব করে তুলবে।
হ্যাঁ, সীমাবদ্ধতা আছে। সমালোচনাও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু হয়তো এভাবেই শুরু হয় পরিবর্তন—যখন কেউ প্রথম সেই পথে হাঁটে, যেখানে আগে কেউ যায়নি।
ব্লু অরিজিনের এই অল-উইমেন মিশন সেই পরিবর্তনের আরেকটি দৃঢ় পদক্ষেপ। এই যাত্রা ছিল দৃশ্যমানতার লড়াইয়ের অংশ—মহাকাশে নারীদের উপস্থিতি কেবল বাস্তব নয়, দৃশ্যমান এবং অনুপ্রেরণাদায়ক।
হয়তো এই মিশনের সবচেয়ে বড় সাফল্য বিজ্ঞানের খাতায় নয়, বরং মননের খাতায় লেখা থাকবে। যদি বিশ্বের কোনো এক প্রান্তে বসে থাকা এক কিশোরী এই ছয়জন নারীকে শূন্য মাধ্যাকর্ষণে ভেসে যেতে দেখে নিজের ভেতরে স্বপ্নের আগুন জ্বালিয়ে তোলে —তাহলে বলা যায়, মিশন সফল হয়েছে ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন